খুলনায় শিক্ষা বোর্ড চাই

১৮৫৭ সালের ২৪ শে জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯১৭ সালে ইংরেজ সরকার ভারতে পশ্চিমা শিক্ষার প্রসার ও
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে লিডস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য স্যার মাইকেল স্যাডলার-কে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেন সেই কমিশন স্যাডলার কমিশন বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন নামে পরিচিত। এই কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, স্যার জিয়াউদ্দিন আহমেদ, জে ডাব্লিউ গ্রেগরি, রামসে মুইর এবং স্যার ফিলিপ হার্টগ। এই কমিশন দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে ১৯১৯ সালে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে, যা পরবর্তীতে ভারত এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্যাডলার কমিশন প্রথম মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপারে একটা বিস্তারিত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পরিবর্তে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করে। সেই সময় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। স্যাডলার কমিশন মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা পরিচালনার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে সেকেন্ডারি ও ইন্টারমিডিয়েট বোর্ড ( Board of Secondary and Intermediate Education ) গঠনের প্রস্তাব করে। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিকে ডিগ্রি কলেজ থেকে পৃথক করে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বা ম্যাট্রিকুলেশনের বদলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াকে যোগ্যতার মানদন্ড হিসেবে গণনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
স্যাডলার কমিশনের রিপোর্টের আলোকে ১৯২১ সালের ৭ই মে ঢাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। ভারত ভাগের পর স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্কুল-কলেজের তদারকি করা একটি মাত্র বোর্ড ঢাকা বোর্ডের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালে ঢাকা বোর্ডকে শুধু ঢাকা বিভাগের জন্য রেখে বাকি তিনটি বিভাগ খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর জন্য আলাদা তিনটি শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা হয়। তখন চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামে স্থাপন না করে কুমিল্লায় স্থাপন করা হয় এবং খুলনা বিভাগের শিক্ষা বোর্ড খুলনায় স্থাপন না করে যশোরে স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিভাগের সংখ্যা থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বর্তমানে তা ৮ টিতে উন্নীত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে খুলনা বিভাগ ভেঙ্গে বরিশাল বিভাগ গঠন করা হয়। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ ভেঙে সিলেট বিভাগ গঠন করা হয়। সেই বছরই কুমিল্লার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিভাগীয় শহরে আরও একটি শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয় ‘মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম’ নামে। ১৯৯৯ সালে নবগঠিত দুই বিভাগ বরিশাল ও সিলেটে নতুন দুটি শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলা নিয়ে রংপুর বিভাগ গঠিত হয়। তার আগেই ২০০৬ সালে এই আটটি জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয়। ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ বিভাগ গঠিত হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগ গঠনের দুই বছরের মধ্যেই ২০১৭ সালে সেখানে শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। সরকার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা বোর্ড গঠন করে। শিক্ষা বোর্ড জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্টিফিকেট প্রদান করে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষা বোর্ডগুলো কাজ করে। একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন প্রয়োজনে সরাসরি শিক্ষা বোর্ডে গমন করে কাজ সম্পন্ন করতে হয়। একজন শিক্ষার্থী যে সমস্ত প্রয়োজনে শিক্ষা বোর্ডের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল সেগুলো হচ্ছে, সার্টিফিকেট উত্তোলন, মার্কসশিট উত্তোলন, নাম সংশোধন, যেকোন বিষয়ে ফলাফল সংশোধন, ভর্তি বাতিল, এক কলেজ থেকে ভর্তি বাতিল করে নতুন কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণ ইত্যাদি।
শিক্ষার্থীদের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ড যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো পালন করে তার মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, স্কুল-কলেজের এফিলিয়েশন প্রদান ও নবায়ন, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি এবং কলেজের গভর্নিং বডি গঠনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান ও তত্ত্বাবধান, স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহকারী প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ নির্ধারণ ও চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান, নির্ধারিত সময়ে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ এবং উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের মাঝে সার্টিফিকেট ও মার্কসশিট বিতরণসহ পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা।
বাংলাদেশে এখন ৮টি বিভাগীয় শহর, তার মধ্যে খুলনা একমাত্র পুরনো বিভাগীয় শহর, যেখানে শিক্ষা বোর্ড নেই।
২০২৩ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বমোট এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ১,৫৮,৩ ৩০ জন। মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৫৫৩ টি। এরমধ্যে বৃহত্তর খুলনা জেলা অর্থাৎ খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরার এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৪,৫৩১ জন। এই তিনটি জেলা থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৮৪ টি। অর্থাৎ যশোর বোর্ডের সম্মিলিত পরীক্ষার্থীর এক তৃতীয়াংশই বসবাস করে বৃহত্তর খুলনা জেলায়। বর্তমানে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ কলেজের সংখ্যা ৫৮১টি। অন্যদিকে ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ কলেজের মিলিত
সংখ্যা ৫৫৬ টি। অর্থাৎ ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিলিত কলেজের সংখ্যা চেয়েও যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ কলেজের সংখ্যা বেশি। খুলনার কয়রা-পাইকগাছার বা বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ-শরণখোলার কিংবা সাতক্ষীরার আশাশুনীর একজন শিক্ষার্থী যখন কোন প্রয়োজনে যশোর বোর্ডে গমন করে কিংবা একজন শিক্ষক যখন জেএসসি, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র গ্রহণ করার জন্য বোর্ডে গমন করেন বা কোন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা কলেজের অধ্যক্ষ যখন কোন দাপ্তরিক প্রয়োজনে যশোর শিক্ষা বোর্ডে গমন করেন, তখন দিনের কাজ দিনে সম্পন্ন করে ঘরে ফিরতে পারেন না। যত ছোট কাজই হোক না কেন, দূরত্বজনিত কারণে তাকে অন্তত এক রাত যশোরের কোন হোটেলে থেকে কাজ সম্পাদন করতে হয়, যা ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া দূরত্বজনিত কারণে যশোর বোর্ড কর্তৃপক্ষও স্কুল-কলেজগুলোর তদারকি যথাযথভাবে করতে পারে না। তাই বৃহত্তর খুলনা জেলার তিনটি জেলা খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরার স্কুল-কলেজগুলোর যথাযথ তত্ত্বাবধানের স্বার্থে বিভাগীয় শহর খুলনায় একটি শিক্ষা বোর্ড স্থাপন এখন সময়ের দাবি। খুলনা শিক্ষা বোর্ড স্থাপিত হলে খুলনাবাসির দীর্ঘদিনের বঞ্চনার যেমন অবসান হবে, তেমনি এই অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক পরিচিতি: জাতীয় ক্রীড়া ভাষ্যকার এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, খুলনা জেলা শাখা।