০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

নজির আহমেদ ছিলেন একজন সৎ ও নির্ভিক কলম সৈনিক

প্রতিনিধির নাম

১৯৯৬ সাল থেকে ঢাকায় কাজ করছি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়। ২০০৪ সালের দিকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলাম অপরাধ বিষয়ক সাহসী পত্রিকা সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায়। সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সম্পাদক এস. এম মোরশেদ একজন পেশাদার সাংবাদিক। ঐ সময়ে যে কয়েকজন অপরাধ বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তার মধ্যে সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সম্পাদক এস. এম মোরশেদ ছিলেন অত্যান্ত সাহসী ও তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রা ছিল দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ, মজুদদার ব্যবসায়ী, সুদখোর ও ঘুষখোরদের আতংক। সেই সময়ের মত অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনে আজও সমানতালে প্রকাশিত হয়ে আসছে সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রা। সত্য প্রকাশে কাউকেই কখনও ছাড় দিতে দেখিনি এস. এম মোরশেদ ও তার সম্পাদিত পত্রিকা সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রাকে।
২০০৪ সালে আমি যখন সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায় যোগদান করলাম তখন দেখলাম সেখানকার রিপোর্টিং বিভাগে বিশাল একটি ঐক্যবদ্ধ টিম ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে কাজ করছে সাহসীকতার সাথে। ঢাকার বাহিরেও প্রতিটি জেলা উপজেলায় রয়েছে পরীক্ষিত সাহসী কলম সৈনিক। তাদের সবাই দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে সরকারি, বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতির সংবাদ সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার মাধ্যমে তুলে ধরছে জাতির কাছে। আমি সেইদিন যুক্ত হয়েছিলাম অপরাধ বিচিত্রার সেই টিমের একজন কলমযোদ্ধা হিসেবে।

আজকের এই লেখার শিরোনাম যাকে দিয়ে শুরু সেই নজির আহমেদও ছিলো সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সেই টিমের একজন সক্রিয় সাহসী নিবেদিত কলমযোদ্ধা। তার অবর্তমানে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ লিখতে হবে এটা কোন দিনই ভাবিনি আমি। আজ লিখতে গিয়েও অবাক লাগে আর বার বার স্মৃতিপটে প্রশ্ন আসে আসলেই কি নজির ভাই আমাদের মাঝে নেই। ঐ সময় আমরা যারা সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায় কর্মরত ছিলাম সেই বিশাল টিমের মধ্যে নজির আহমেদ ছিলেন শান্ত, ভদ্র ও বিনয়ী একজন সাংবাদিক। তাড়াহুড়ো করে তথ্য ঘাটতি রেখে কোন সংবাদ তাকে আমি লিখতে দেখিনি। তার প্রতিটি প্রতিবেদনই ছিল তথ্য নির্ভর এবং নিরপেক্ষতায় ভরপুর। একটি প্রতিবেদন তৈরী করতে প্রয়োজনীয় সময় ও মেধা ব্যয় করতেন নজির আহমেদ। যতদিন আমি তার সহকর্মী ছিলাম ততদিন সে প্রতিটি প্রতিবেদন তৈরীর ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ ও সহযোগিতা নিতেন। আমার সাথে প্রতিটি বিষয়ে ভাগাভাগি করতেন। আমিও নজির আহমেদ ভাইকে যথাসাধ্য সহযোগীতা করতে চেষ্টা করতাম। কর্ম দক্ষতার কারণেই তার সাথে আমার সখ্যতা চলে যায় গভীরে। আমি ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায় স্টাফ রিপোর্টার থেকে চীফ রিপোর্টার এবং বার্তা সম্পাদক পদেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছি। সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার টিম থেকে আমরা নানাজন ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যমে চলে গেলেও নজির আহমেদ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায়ই কর্মরত ছিলেন।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ছিল বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের পদক প্রদান অনুষ্ঠান। তথ্য ভবনের সেই অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে দেশের প্রতিথযশা সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। নজির আহমেদও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। আমি অনুষ্ঠানের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থাকলেও নজির ভাইকে সেই অনুষ্ঠানে দেখতে পাইনি। তখন থেকেই মনে নানা প্রশ্ন এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান নজির ভাই কখনও মিস করেননি। অনুষ্ঠান শেষ করে আমি এবং রুর‌্যাল জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন (আরজেএফ) এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিদ্দিকুর রহমান আজাদী পল্টন মোড় আসতেই নজির ভাইর সাথে দেখা। দারুস-সালাম আর্কেটের সামনে থেকে আমার সাথে কথা বলতে রাস্তা পার হলেন। চায়ের দোকানের সামনে গেলেই আমি নজির ভাইকে প্রতিদিনের মত চা খাওয়ার কথা বললাম। প্রতিদিন এক কাপ চা দুইজনে খাওয়া আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। নজির ভাই আমাকে বলল বিশেষ জরুরী কাজ থাকায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি তিনি। তখন নজির ভাইকে খুব বিষন্ন লাগছিল। তার সারা গায়ে ছিল ঘাম ও ক্লান্তি।

 

নজির ভাই আমাকে তাড়াহুড়া করে বলল, বাসায় চলে যাই। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত নজির ভাই আমার সাথে ছিল। সেই দেখাই নজির ভাইর সাথে আমার শেষ দেখা। তারপর যা শুনলাম তা খুবই দুঃখজনক ও মেনে নেয়া কষ্টকর। তার পরিবারের ভাষ্যমতে ঐদিন রাত ৯টার দিকে এশার নামাজ পড়া অবস্থায় মাথা ঘুরে পরে যান নজির ভাই। তারপর তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান নজির ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা চেয়েছিলাম মিডিয়াপাড়া অথবা জাতীয় প্রেসক্লাবে শেষ জানাযা হবে নজির ভাইর। সেখানে শেষ দেখার সুযোগ পাবে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। তারপর তার গ্রামের বাড়ী লক্ষীপুরে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হবে। কিন্তু তার পারিবারিক সিদ্ধান্তের কারণেই রাতেই তাকে গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ায় সহকর্মীদের ভাগ্যে নজির ভাইকে শেষ দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের।

 

২০০৭ সালে যখন রুর‌্যাল জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন (আরজেএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথমদিন থেকেই নজির ভাই আমাদের সাথে ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা কমিটিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হন। তার সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল গভীরের। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত জানাতেন তিনি। আরজেএফ’র একজন নিবেদিত নেতা ছিলেন নজির ভাই। প্রতিটি অনুষ্ঠানের অর্থ যোগান ও সুন্দর করে একটি অনুষ্ঠান শেষ করার জন্য সকল চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন নজির ভাই। আরজেএফকে সংগঠিত করার জন্য সদস্য সংগ্রহ, সাংগঠনিক সকল জেলা ও উপজেলায় কমিটি গঠনের বিষয়ে তার কৌশল আজ মনে পরার মত। নজির ভাই ছিলেন স্পষ্টবাদী। সংগঠনের বিষয়ে সব সময় সরল কথা বলতেন। কাউকে সমীহ করে সত্য লুকাতেন না। একজন মানবপ্রেমী, সদালাপী ছিলেন নজির ভাই। তিনি সব সময় বাস্তবমুখী জীবন যাপন করতেন। সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা কখনও প্রশ্রয় দিতেন না। একজন সহজ সরল মানুষ থাকার কারণে অনেকেই তাকে ঠকিয়েছেন কিন্তু নজির ভাই কাউকে সামান্যতম কষ্ট দিয়েছেন এমন ইতিহাস আমার নাই। পোশাকে, চলনে বলনে নজির ভাই ছিলেন একজন সাধারণ মাটির মানুষ।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, পিবিআইবিসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষন, সভা সেমিনারের উপস্থিত থেকে সাংবাদিকদের বাস্তবমুখী কর্মসংস্থান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলতেন নজির ভাই। সব সময় হাসিমুখে সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন তিনি।

 

তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে স্মরণ সভা, তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিভিন্ন সংগঠন মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ব্যক্তিগত জীবনে নাজির আহমেদ একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। পারিবারিক জীবনে ১ স্ত্রী ও ৩ জন কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। কোন ছেলে সন্তান আল্লাহ তাকে দেননি। তার রেখে যাওয়া সন্তানদের লেখাপড়া ও পারিবারিক পরিচালনায় তার পাশে থেকে আমরা যারা নজির ভাইর স্বজন রয়েছি তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন সকল সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে নজির ভাইর পরিবারের খোঁজ খবর নেই এবং তাদের পাশে থাকি।
নজির ভাই তার এলাকা লক্ষীপুরেও সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। নজির ভাই স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছেও একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। সামাজিক জীবনে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে সমাজউন্নয়ন ও সামাজিক অবক্ষয়রোধে কাজ করে গেছেন।
লক্ষীপুর ও বৃহত্তম নোয়াখালীতে নজির ভাই বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। ঢাকায়ও বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের অগ্রভাবে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অর্গানাইজেশন (এফবিজেও)’র ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। সাংবাদিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজির ভাই ছিলেন সদা সোচ্চার। একজন পেশাদার আপদমস্তক সাংবাদিক ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য কোন পেশা বা ব্যবসা বাণিজ্য তার ছিল না।

ট্যাগস :
আপডেট : ০৩:৩৩:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩
৫৬ বার পড়া হয়েছে

নজির আহমেদ ছিলেন একজন সৎ ও নির্ভিক কলম সৈনিক

আপডেট : ০৩:৩৩:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০২৩

১৯৯৬ সাল থেকে ঢাকায় কাজ করছি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়। ২০০৪ সালের দিকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলাম অপরাধ বিষয়ক সাহসী পত্রিকা সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায়। সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সম্পাদক এস. এম মোরশেদ একজন পেশাদার সাংবাদিক। ঐ সময়ে যে কয়েকজন অপরাধ বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তার মধ্যে সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সম্পাদক এস. এম মোরশেদ ছিলেন অত্যান্ত সাহসী ও তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রা ছিল দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ, মজুদদার ব্যবসায়ী, সুদখোর ও ঘুষখোরদের আতংক। সেই সময়ের মত অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনে আজও সমানতালে প্রকাশিত হয়ে আসছে সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রা। সত্য প্রকাশে কাউকেই কখনও ছাড় দিতে দেখিনি এস. এম মোরশেদ ও তার সম্পাদিত পত্রিকা সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রাকে।
২০০৪ সালে আমি যখন সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায় যোগদান করলাম তখন দেখলাম সেখানকার রিপোর্টিং বিভাগে বিশাল একটি ঐক্যবদ্ধ টিম ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে কাজ করছে সাহসীকতার সাথে। ঢাকার বাহিরেও প্রতিটি জেলা উপজেলায় রয়েছে পরীক্ষিত সাহসী কলম সৈনিক। তাদের সবাই দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে সরকারি, বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতির সংবাদ সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার মাধ্যমে তুলে ধরছে জাতির কাছে। আমি সেইদিন যুক্ত হয়েছিলাম অপরাধ বিচিত্রার সেই টিমের একজন কলমযোদ্ধা হিসেবে।

আজকের এই লেখার শিরোনাম যাকে দিয়ে শুরু সেই নজির আহমেদও ছিলো সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সেই টিমের একজন সক্রিয় সাহসী নিবেদিত কলমযোদ্ধা। তার অবর্তমানে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ লিখতে হবে এটা কোন দিনই ভাবিনি আমি। আজ লিখতে গিয়েও অবাক লাগে আর বার বার স্মৃতিপটে প্রশ্ন আসে আসলেই কি নজির ভাই আমাদের মাঝে নেই। ঐ সময় আমরা যারা সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায় কর্মরত ছিলাম সেই বিশাল টিমের মধ্যে নজির আহমেদ ছিলেন শান্ত, ভদ্র ও বিনয়ী একজন সাংবাদিক। তাড়াহুড়ো করে তথ্য ঘাটতি রেখে কোন সংবাদ তাকে আমি লিখতে দেখিনি। তার প্রতিটি প্রতিবেদনই ছিল তথ্য নির্ভর এবং নিরপেক্ষতায় ভরপুর। একটি প্রতিবেদন তৈরী করতে প্রয়োজনীয় সময় ও মেধা ব্যয় করতেন নজির আহমেদ। যতদিন আমি তার সহকর্মী ছিলাম ততদিন সে প্রতিটি প্রতিবেদন তৈরীর ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ ও সহযোগিতা নিতেন। আমার সাথে প্রতিটি বিষয়ে ভাগাভাগি করতেন। আমিও নজির আহমেদ ভাইকে যথাসাধ্য সহযোগীতা করতে চেষ্টা করতাম। কর্ম দক্ষতার কারণেই তার সাথে আমার সখ্যতা চলে যায় গভীরে। আমি ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায় স্টাফ রিপোর্টার থেকে চীফ রিপোর্টার এবং বার্তা সম্পাদক পদেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছি। সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার টিম থেকে আমরা নানাজন ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যমে চলে গেলেও নজির আহমেদ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রায়ই কর্মরত ছিলেন।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ছিল বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের পদক প্রদান অনুষ্ঠান। তথ্য ভবনের সেই অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে দেশের প্রতিথযশা সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। নজির আহমেদও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। আমি অনুষ্ঠানের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থাকলেও নজির ভাইকে সেই অনুষ্ঠানে দেখতে পাইনি। তখন থেকেই মনে নানা প্রশ্ন এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান নজির ভাই কখনও মিস করেননি। অনুষ্ঠান শেষ করে আমি এবং রুর‌্যাল জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন (আরজেএফ) এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিদ্দিকুর রহমান আজাদী পল্টন মোড় আসতেই নজির ভাইর সাথে দেখা। দারুস-সালাম আর্কেটের সামনে থেকে আমার সাথে কথা বলতে রাস্তা পার হলেন। চায়ের দোকানের সামনে গেলেই আমি নজির ভাইকে প্রতিদিনের মত চা খাওয়ার কথা বললাম। প্রতিদিন এক কাপ চা দুইজনে খাওয়া আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। নজির ভাই আমাকে বলল বিশেষ জরুরী কাজ থাকায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি তিনি। তখন নজির ভাইকে খুব বিষন্ন লাগছিল। তার সারা গায়ে ছিল ঘাম ও ক্লান্তি।

 

নজির ভাই আমাকে তাড়াহুড়া করে বলল, বাসায় চলে যাই। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত নজির ভাই আমার সাথে ছিল। সেই দেখাই নজির ভাইর সাথে আমার শেষ দেখা। তারপর যা শুনলাম তা খুবই দুঃখজনক ও মেনে নেয়া কষ্টকর। তার পরিবারের ভাষ্যমতে ঐদিন রাত ৯টার দিকে এশার নামাজ পড়া অবস্থায় মাথা ঘুরে পরে যান নজির ভাই। তারপর তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান নজির ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা চেয়েছিলাম মিডিয়াপাড়া অথবা জাতীয় প্রেসক্লাবে শেষ জানাযা হবে নজির ভাইর। সেখানে শেষ দেখার সুযোগ পাবে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। তারপর তার গ্রামের বাড়ী লক্ষীপুরে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হবে। কিন্তু তার পারিবারিক সিদ্ধান্তের কারণেই রাতেই তাকে গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ায় সহকর্মীদের ভাগ্যে নজির ভাইকে শেষ দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের।

 

২০০৭ সালে যখন রুর‌্যাল জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন (আরজেএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথমদিন থেকেই নজির ভাই আমাদের সাথে ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা কমিটিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হন। তার সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল গভীরের। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত জানাতেন তিনি। আরজেএফ’র একজন নিবেদিত নেতা ছিলেন নজির ভাই। প্রতিটি অনুষ্ঠানের অর্থ যোগান ও সুন্দর করে একটি অনুষ্ঠান শেষ করার জন্য সকল চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন নজির ভাই। আরজেএফকে সংগঠিত করার জন্য সদস্য সংগ্রহ, সাংগঠনিক সকল জেলা ও উপজেলায় কমিটি গঠনের বিষয়ে তার কৌশল আজ মনে পরার মত। নজির ভাই ছিলেন স্পষ্টবাদী। সংগঠনের বিষয়ে সব সময় সরল কথা বলতেন। কাউকে সমীহ করে সত্য লুকাতেন না। একজন মানবপ্রেমী, সদালাপী ছিলেন নজির ভাই। তিনি সব সময় বাস্তবমুখী জীবন যাপন করতেন। সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা কখনও প্রশ্রয় দিতেন না। একজন সহজ সরল মানুষ থাকার কারণে অনেকেই তাকে ঠকিয়েছেন কিন্তু নজির ভাই কাউকে সামান্যতম কষ্ট দিয়েছেন এমন ইতিহাস আমার নাই। পোশাকে, চলনে বলনে নজির ভাই ছিলেন একজন সাধারণ মাটির মানুষ।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, পিবিআইবিসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষন, সভা সেমিনারের উপস্থিত থেকে সাংবাদিকদের বাস্তবমুখী কর্মসংস্থান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলতেন নজির ভাই। সব সময় হাসিমুখে সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন তিনি।

 

তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে স্মরণ সভা, তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিভিন্ন সংগঠন মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ব্যক্তিগত জীবনে নাজির আহমেদ একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। পারিবারিক জীবনে ১ স্ত্রী ও ৩ জন কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। কোন ছেলে সন্তান আল্লাহ তাকে দেননি। তার রেখে যাওয়া সন্তানদের লেখাপড়া ও পারিবারিক পরিচালনায় তার পাশে থেকে আমরা যারা নজির ভাইর স্বজন রয়েছি তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন সকল সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে নজির ভাইর পরিবারের খোঁজ খবর নেই এবং তাদের পাশে থাকি।
নজির ভাই তার এলাকা লক্ষীপুরেও সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। নজির ভাই স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছেও একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। সামাজিক জীবনে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে সমাজউন্নয়ন ও সামাজিক অবক্ষয়রোধে কাজ করে গেছেন।
লক্ষীপুর ও বৃহত্তম নোয়াখালীতে নজির ভাই বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। ঢাকায়ও বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের অগ্রভাবে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অর্গানাইজেশন (এফবিজেও)’র ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। সাংবাদিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজির ভাই ছিলেন সদা সোচ্চার। একজন পেশাদার আপদমস্তক সাংবাদিক ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য কোন পেশা বা ব্যবসা বাণিজ্য তার ছিল না।