০১:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

বাঙালি জাতির আত্মোপলব্ধি,আত্ম-জাগরণ ও স্বাধীনতার প্রথম সোপান

প্রতিনিধির নাম

ফাইল ছবি

বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১-এর স্বাধীন মানচিত্র। বৃটিশ শাসনোত্তর বাংলাভাষা-আন্দোলন বাঙালি জাতিকে দিয়েছে তার আপন সত্তা আবিস্কারের পরম মহিমা,জাতীয় ঐক্য ও আপন ঠিকানা তথা সার্বভৌম স্বাধীনতার অদম্য প্রেরণা।

মূলতঃ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সুবিশাল ও সুবিস্তৃত। অতঃপর ধাপে ধাপে সুতীব্র আন্দোলন ও সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী ধারার পথ বেয়ে বেয়ে ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৫২ হয়ে, অতঃপর যার সমাপ্তি ঘটে খৃঃ ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বরে এসে । ঙালিদেরকে বাংলাভাষা আন্দোলনে বাধ্য করে ১৯৪৭ সনে তথা প্রাক পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুর লগ্ন থেকেই। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উর্দুভাষী উপাচার্যের মাথায় আসে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হতে হবে উর্দু। এই কথা, তৎকালীন পাক নেতৃবৃন্দের মাথা হতে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই মেসেজটি পৌঁছে যায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পর্যন্ত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলো বাঙালি জনগোষ্ঠী। এতদসত্ত্বেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সকল নেতৃবৃন্দকে অাশ্বস্থ করেন যে, নিশ্চয়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। তিনি করাচি ও ঢাকায় উভয় শহরে তাঁর এই খায়েশের মৌখিক ঘোষণাটি দিয়েই ফেলেন। সেটি তখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন কিংবা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়, ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন। পরে এটি গণ আন্দোলনেও রূপ নেয়। ভাষাবিদ ড. শহীদুল্লাহর লেখা থেকে এর বিস্তারিত ইতিহাস জানা যায়। অতঃপর জনাব গাজিউল সাহেবের উদ্ধৃতি থেকে ভাষা আন্দোলনে সর্বাগ্রে যাঁর নাম আসে, তিনি হলেন- শাশ্বত বাঙালির স্বপ্নপুরুষ, নবযৌবনের গতিশীল, দুঃসাহসিক আর অপ্রতিরোধ্য যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের। ভাষা আন্দোলনের প্রধান কারণটাই ছিলো- বাঙালির আত্মোপলব্ধি, বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও উর্দু ওয়ালাদের অপরিনামদর্শী সব উদ্ভট সিদ্ধান্ত।

বাঙালিরা অনুভব করেছিলো- তাঁরা নিজ ভূমে থেকেও যেনো পরবাসী’সম। ভাষা ও অধিকার স্বাধিকারের এই আত্মোপলব্ধি হতেই- বাঙালির আত্ম-জাগরণনের স্বপ্নবেদীতে রচিত হয়, স্বাধিকার হতে স্বাধীনতা অর্জনের এক প্রদীপ্ত সংগ্রামের সোপান।
১৯৪৭-এর শুরুতেই বাঙালি টের পেতে থাকে পাকিস্তানের জনসংখ্যানুপাতে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জনগোষ্ঠি হওয়া সত্ত্বেও, বৃটিশের ইংরেজ দুঃশাসন হতে এবার বুঝি এই নিরীহ-নিপীড়িত বাঙালি জাতি- উর্দু ভাষার পরিমন্ডলে আরেকটি শাসন-শৃঙ্খল বেড়ীতে বাঘবন্দি হতে যাচ্ছে।
১৯৪৭ সনেই সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী দাবীকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার বিরুদ্ধে- কলিকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোটেলে বাংলা ভাষার আন্দোলন ত্বরান্বিত করার জন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ্ কায়সার,কাজী ইদ্রিস রাজশাহীর আতাউর রহমান প্রমূখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

ড.শহীদুল্লাহর একটি লেখা থেকে জানা যায়, বৃটিশোত্তর, স্বার্থলোভী কিছু পশ্চিমী মুসলিম নেতা ও বৃটিশদের “ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি” অবস্থার ফলে, পাকিস্তান নামক একটি নুতন দেশ হবে, উর্দু ভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ এই দেশটির রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হবে, এটি তাঁদের সেই সময়ের স্বপ্ন বা খায়েশ ছিলো। এই ষড়যন্ত্রেরব আরেকটি নিগূঢ় সূত্রপাত ঘটে প্রস্তাবিত (প্রাক) পাকিস্তানি নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র তৎকালীন সতীর্থ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুভাষী একজন উপাচার্যের পরামর্শকে আমলে নিয়ে। অতএব, আর যায় কোথায়…! বাঙালিও সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়!
বাঙালিও তার আত্ম-পরিচয়ের কঠিন স্বপ্নে- ১৯৪৭ সন হতেই সর্বাত্মক মুক্তির শপথ গ্রহন করে। এরপর ১৯৪৮ আসে। শেখ মুজিব তমুদ্দুনে মজলিসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৫০ নং মোগলটুলি লেনের বাড়িতে তৈরি করেন আন্দোলনের রূপ রেখা। ঘোঘণা করেন ২১ দফা। যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষা সহ নানাবিধ দাবীসহ আদায়ের একটি ইস্তেহার নামে পরিচিতি পায়।
পরে এটি খাঁজা নাজিমুদ্দিনের মাধ্যমে পাক নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে গেলেও, কায়েদে আযম সিদ্ধান্তে অটল
থাকেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে ।

একপর্যায়ে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে ২ মার্চ ১৯৪৮ সনে রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালির প্রাণের দাবী বাংলাভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে মৌখিক ঘোষণাটি দিয়ে বসেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর বিধি করে তাঁর ভিন্ন!মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সনে ইন্তেকাল করেন। নুতন গভর্নর হন লিযাকত আলী খান। আশ্চর্যের বিষয় হলো- বাঙালির ভাষা আন্দোলনের আগাম মেসেজ পাওয়া সত্বেও তাঁদের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার ভুতটা তখনো দূর হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দু ওয়ালা কর্তৃক উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া ভাষার প্রাক পরিকল্পনার জল্পনাকল্পনার মধ্যে এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ছাত্র সমাজ ও জনতার আন্দোলনও থেমে নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন তখনো চলমান।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের- কখনো বট তলায়, কখনো আম তলায় সভা ঘর্মঘট করেই যাচ্ছেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বট তলায় প্রতিবাদ সভা করতে গিয়ে ১১ মার্চ ১৯৫২ সনে গ্রেফতার হন। অবশ্য অবস্থা বেগতিক দেখে, নেতৃবৃন্দের চাপে তাঁকে ১৫ মার্চ তারিখে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়। অতঃপর ১৯৫২ সালের ২১ মার্চ বৃহত্তর আন্দোলনের আঁচ পেয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। কিন্তু অদম্য ছাত্র সমাজ ও সাধারণ জনতা এই ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে পড়ে। এদিনের ইতিহাস সবারই জানা। মিছিলে পুলিশের গুলি ছোঁড়া হলো এবং বাংলা ভাষার জন্য এদিন শহীদ হন, রফিক, জব্বার, সফিক ও পরে হাসপাতালে শহীদ আরো দু’জন। বাঙলার মানুষ পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলো, শুধু ভাষাই নয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানা ভাবে, বলা যায় সর্বতোভাবে বাঙালিদেরকে শোষণ করতে শুরু করেছে । তবে কতিপয় নিষ্পাপ তাজা প্রাণকে অকালে ঝরে পড়তে হলো শুধু মাতৃভাষার দাবীর জন্য, যা বাঙালির চেতনায় একটি প্রচন্ড আঘাত রূপে চিহ্নিত হয়ে গেলো।
সুতরাং এটিকে কেন্দ্র করে, আন্দোলন দিন দিন বেগবান হয়ে ওঠে এবং ১৯৫২ সনেই উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষাকেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় সূচনা রচিত হয়।

ঢাকায় শহরে তৈরী হলো, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। বাঙালিরা প্রতিবছর ভাষা শহীদদের স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবেও ঘোঘণা করা হলো।
বাঙালি আন্দোলন থেমে নেই। ভাষা আন্দোলনের বিষয়কে সোপান হিসেবে বুকে ধারণ করে এবং শোককে শক্তি হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করে, বাঙালি ঘটনা পরম্পরায় ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন অব্যাহত রাখলো।
অতঃপর, এই সব নানাহ্ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৬৯-এ। অতঃপর ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়। ওরা এই বিজয়কেও মানতে চাইলো না, মানতে রাজী নয়।
আর এই অবধারিত মহাবিস্ফোরণের কঠিন আঘাতে অনাকাঙ্ক্ষিতই বাঙালির ভালে চলে আসে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ নামক ইতিহাসের একটি জঘন্যতম ও ঘৃণ্যতম কালোরাত্রির দানবীয় থাবা । দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালি- ব্যাঘ্র হুংকারে ঘুরে দাঁড়ায়। পূর্ব বাঙলার বাঙালিরা, আমরা নয়টি মাস রক্তক্ষয়ী মরণপণ যুদ্ধ করি।
অতঃপর- ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিপাগল বাঙালিরা, নির্লজ্জ ও বেহায়াপনা পাকিস্তানি উর্দুওয়ালা হায়েনার থাবার হাতকে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ পাকিস্তানিরা অসহায়ের মতো পরাজিত হয়। তবে আমাদের গুনতে হয়, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তাক্ত লাশ! বাঙালি মুক্তিবাহিনীর সাথে সেই যুদ্ধে, প্রায় একলক্ষ পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে, আত্মসমর্পণ করতেও বাধ্য হয়।

ত্রিশ লক্ষ বাঙালির লোহিত রক্তের উষ্ণ স্রোত বেয়ে অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিনিয়ে আনা হয় সেই আরাধ্য বিজয় ও স্বাধীনতা। অতঃপর, বিশ্ব পতাকার মিছিলে যোগ হয়- সবুজের মাঝে, লাল সূর্য আঁকাএকটি পতাকা বাঙলার আকাশে চিরভাস্বর হয়ে উদ্ভাসিত হয়- সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্নের একটি ঠিকানা । ভাষা সংগ্রাম থেকে সূচিত হওয়া লড়াইয়ে আজ লাল-সবুজের একটি পতাকা প্রোজ্জ্বল হয়ে, সগৌরবে পত্ পত্ করে উড়ে বাঙলার আকাশে বাতাসে। দুলছে সংগ্রামী বাঙালির নয়নের তারায় তারায়। যে পতাকার নাম বাংলাদেশ,স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ আমাদের বাংলাদেশ ।

ট্যাগস :
আপডেট : ০৯:৫৬:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
১৬৮ বার পড়া হয়েছে

বাঙালি জাতির আত্মোপলব্ধি,আত্ম-জাগরণ ও স্বাধীনতার প্রথম সোপান

আপডেট : ০৯:৫৬:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১-এর স্বাধীন মানচিত্র। বৃটিশ শাসনোত্তর বাংলাভাষা-আন্দোলন বাঙালি জাতিকে দিয়েছে তার আপন সত্তা আবিস্কারের পরম মহিমা,জাতীয় ঐক্য ও আপন ঠিকানা তথা সার্বভৌম স্বাধীনতার অদম্য প্রেরণা।

মূলতঃ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সুবিশাল ও সুবিস্তৃত। অতঃপর ধাপে ধাপে সুতীব্র আন্দোলন ও সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী ধারার পথ বেয়ে বেয়ে ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৫২ হয়ে, অতঃপর যার সমাপ্তি ঘটে খৃঃ ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বরে এসে । ঙালিদেরকে বাংলাভাষা আন্দোলনে বাধ্য করে ১৯৪৭ সনে তথা প্রাক পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুর লগ্ন থেকেই। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উর্দুভাষী উপাচার্যের মাথায় আসে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হতে হবে উর্দু। এই কথা, তৎকালীন পাক নেতৃবৃন্দের মাথা হতে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই মেসেজটি পৌঁছে যায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পর্যন্ত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিলো বাঙালি জনগোষ্ঠী। এতদসত্ত্বেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সকল নেতৃবৃন্দকে অাশ্বস্থ করেন যে, নিশ্চয়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। তিনি করাচি ও ঢাকায় উভয় শহরে তাঁর এই খায়েশের মৌখিক ঘোষণাটি দিয়েই ফেলেন। সেটি তখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন কিংবা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়, ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন। পরে এটি গণ আন্দোলনেও রূপ নেয়। ভাষাবিদ ড. শহীদুল্লাহর লেখা থেকে এর বিস্তারিত ইতিহাস জানা যায়। অতঃপর জনাব গাজিউল সাহেবের উদ্ধৃতি থেকে ভাষা আন্দোলনে সর্বাগ্রে যাঁর নাম আসে, তিনি হলেন- শাশ্বত বাঙালির স্বপ্নপুরুষ, নবযৌবনের গতিশীল, দুঃসাহসিক আর অপ্রতিরোধ্য যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের। ভাষা আন্দোলনের প্রধান কারণটাই ছিলো- বাঙালির আত্মোপলব্ধি, বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও উর্দু ওয়ালাদের অপরিনামদর্শী সব উদ্ভট সিদ্ধান্ত।

বাঙালিরা অনুভব করেছিলো- তাঁরা নিজ ভূমে থেকেও যেনো পরবাসী’সম। ভাষা ও অধিকার স্বাধিকারের এই আত্মোপলব্ধি হতেই- বাঙালির আত্ম-জাগরণনের স্বপ্নবেদীতে রচিত হয়, স্বাধিকার হতে স্বাধীনতা অর্জনের এক প্রদীপ্ত সংগ্রামের সোপান।
১৯৪৭-এর শুরুতেই বাঙালি টের পেতে থাকে পাকিস্তানের জনসংখ্যানুপাতে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জনগোষ্ঠি হওয়া সত্ত্বেও, বৃটিশের ইংরেজ দুঃশাসন হতে এবার বুঝি এই নিরীহ-নিপীড়িত বাঙালি জাতি- উর্দু ভাষার পরিমন্ডলে আরেকটি শাসন-শৃঙ্খল বেড়ীতে বাঘবন্দি হতে যাচ্ছে।
১৯৪৭ সনেই সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী দাবীকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করার বিরুদ্ধে- কলিকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোটেলে বাংলা ভাষার আন্দোলন ত্বরান্বিত করার জন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ্ কায়সার,কাজী ইদ্রিস রাজশাহীর আতাউর রহমান প্রমূখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

ড.শহীদুল্লাহর একটি লেখা থেকে জানা যায়, বৃটিশোত্তর, স্বার্থলোভী কিছু পশ্চিমী মুসলিম নেতা ও বৃটিশদের “ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি” অবস্থার ফলে, পাকিস্তান নামক একটি নুতন দেশ হবে, উর্দু ভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ এই দেশটির রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হবে, এটি তাঁদের সেই সময়ের স্বপ্ন বা খায়েশ ছিলো। এই ষড়যন্ত্রেরব আরেকটি নিগূঢ় সূত্রপাত ঘটে প্রস্তাবিত (প্রাক) পাকিস্তানি নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র তৎকালীন সতীর্থ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুভাষী একজন উপাচার্যের পরামর্শকে আমলে নিয়ে। অতএব, আর যায় কোথায়…! বাঙালিও সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়!
বাঙালিও তার আত্ম-পরিচয়ের কঠিন স্বপ্নে- ১৯৪৭ সন হতেই সর্বাত্মক মুক্তির শপথ গ্রহন করে। এরপর ১৯৪৮ আসে। শেখ মুজিব তমুদ্দুনে মজলিসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৫০ নং মোগলটুলি লেনের বাড়িতে তৈরি করেন আন্দোলনের রূপ রেখা। ঘোঘণা করেন ২১ দফা। যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষা সহ নানাবিধ দাবীসহ আদায়ের একটি ইস্তেহার নামে পরিচিতি পায়।
পরে এটি খাঁজা নাজিমুদ্দিনের মাধ্যমে পাক নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে গেলেও, কায়েদে আযম সিদ্ধান্তে অটল
থাকেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে ।

একপর্যায়ে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে ২ মার্চ ১৯৪৮ সনে রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালির প্রাণের দাবী বাংলাভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে মৌখিক ঘোষণাটি দিয়ে বসেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর বিধি করে তাঁর ভিন্ন!মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সনে ইন্তেকাল করেন। নুতন গভর্নর হন লিযাকত আলী খান। আশ্চর্যের বিষয় হলো- বাঙালির ভাষা আন্দোলনের আগাম মেসেজ পাওয়া সত্বেও তাঁদের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার ভুতটা তখনো দূর হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দু ওয়ালা কর্তৃক উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া ভাষার প্রাক পরিকল্পনার জল্পনাকল্পনার মধ্যে এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ছাত্র সমাজ ও জনতার আন্দোলনও থেমে নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন তখনো চলমান।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের- কখনো বট তলায়, কখনো আম তলায় সভা ঘর্মঘট করেই যাচ্ছেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বট তলায় প্রতিবাদ সভা করতে গিয়ে ১১ মার্চ ১৯৫২ সনে গ্রেফতার হন। অবশ্য অবস্থা বেগতিক দেখে, নেতৃবৃন্দের চাপে তাঁকে ১৫ মার্চ তারিখে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়। অতঃপর ১৯৫২ সালের ২১ মার্চ বৃহত্তর আন্দোলনের আঁচ পেয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। কিন্তু অদম্য ছাত্র সমাজ ও সাধারণ জনতা এই ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে পড়ে। এদিনের ইতিহাস সবারই জানা। মিছিলে পুলিশের গুলি ছোঁড়া হলো এবং বাংলা ভাষার জন্য এদিন শহীদ হন, রফিক, জব্বার, সফিক ও পরে হাসপাতালে শহীদ আরো দু’জন। বাঙলার মানুষ পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলো, শুধু ভাষাই নয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানা ভাবে, বলা যায় সর্বতোভাবে বাঙালিদেরকে শোষণ করতে শুরু করেছে । তবে কতিপয় নিষ্পাপ তাজা প্রাণকে অকালে ঝরে পড়তে হলো শুধু মাতৃভাষার দাবীর জন্য, যা বাঙালির চেতনায় একটি প্রচন্ড আঘাত রূপে চিহ্নিত হয়ে গেলো।
সুতরাং এটিকে কেন্দ্র করে, আন্দোলন দিন দিন বেগবান হয়ে ওঠে এবং ১৯৫২ সনেই উর্দুর পাশাপাশি বাংলাভাষাকেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় সূচনা রচিত হয়।

ঢাকায় শহরে তৈরী হলো, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। বাঙালিরা প্রতিবছর ভাষা শহীদদের স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবেও ঘোঘণা করা হলো।
বাঙালি আন্দোলন থেমে নেই। ভাষা আন্দোলনের বিষয়কে সোপান হিসেবে বুকে ধারণ করে এবং শোককে শক্তি হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করে, বাঙালি ঘটনা পরম্পরায় ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন অব্যাহত রাখলো।
অতঃপর, এই সব নানাহ্ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৬৯-এ। অতঃপর ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়। ওরা এই বিজয়কেও মানতে চাইলো না, মানতে রাজী নয়।
আর এই অবধারিত মহাবিস্ফোরণের কঠিন আঘাতে অনাকাঙ্ক্ষিতই বাঙালির ভালে চলে আসে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ নামক ইতিহাসের একটি জঘন্যতম ও ঘৃণ্যতম কালোরাত্রির দানবীয় থাবা । দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালি- ব্যাঘ্র হুংকারে ঘুরে দাঁড়ায়। পূর্ব বাঙলার বাঙালিরা, আমরা নয়টি মাস রক্তক্ষয়ী মরণপণ যুদ্ধ করি।
অতঃপর- ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিপাগল বাঙালিরা, নির্লজ্জ ও বেহায়াপনা পাকিস্তানি উর্দুওয়ালা হায়েনার থাবার হাতকে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ পাকিস্তানিরা অসহায়ের মতো পরাজিত হয়। তবে আমাদের গুনতে হয়, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তাক্ত লাশ! বাঙালি মুক্তিবাহিনীর সাথে সেই যুদ্ধে, প্রায় একলক্ষ পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে, আত্মসমর্পণ করতেও বাধ্য হয়।

ত্রিশ লক্ষ বাঙালির লোহিত রক্তের উষ্ণ স্রোত বেয়ে অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিনিয়ে আনা হয় সেই আরাধ্য বিজয় ও স্বাধীনতা। অতঃপর, বিশ্ব পতাকার মিছিলে যোগ হয়- সবুজের মাঝে, লাল সূর্য আঁকাএকটি পতাকা বাঙলার আকাশে চিরভাস্বর হয়ে উদ্ভাসিত হয়- সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্নের একটি ঠিকানা । ভাষা সংগ্রাম থেকে সূচিত হওয়া লড়াইয়ে আজ লাল-সবুজের একটি পতাকা প্রোজ্জ্বল হয়ে, সগৌরবে পত্ পত্ করে উড়ে বাঙলার আকাশে বাতাসে। দুলছে সংগ্রামী বাঙালির নয়নের তারায় তারায়। যে পতাকার নাম বাংলাদেশ,স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ আমাদের বাংলাদেশ ।