০১:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

ভোলা গ্রাম থেকে আধুনিক গুলশানের ইতিকথা

প্রতিনিধির নাম

রাজধানী ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোর তালিকা করতে বলা হলে সর্ব প্রথমেই উচ্চারিত হবে গুলশানের নাম। এ যেন ঢাকার বুকে এক টুকরো নিউইয়র্ক, কানাডা  কিংবা লন্ডন।

অত্যাধুনিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে এখানে। রাস্তায় সাধারণ প্রাইভেট কারের চেয়ে হ্যামার, রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, টয়োটা প্রিমিও কিংবা রোলস রয়েসের মতো বিলাসবহুল গাড়িই চোখে পড়ে বেশি, যা এখানকার অধিবাসীদের আর্থিক সামর্থ্যের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো গত শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্তও এই এলাকার না ছিলো অভিজাত দশা, না ছিল এর গালভরা ‘গুলশান’ নামটি। বরং এটি ছিল নিতান্তই একটি অজোপাড়াগাঁ। স্থানীয়রা যাকে  চিনতো ‘ভোলা গ্রাম’ নামে। বর্তমান গুলশানে গিয়ে এ নামের অস্তিত্ব হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সবেধন ‘নাীলমণি’ হিসেবে রয়েছে কেবল দক্ষিণ বাড্ডার “ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”। কিন্তু তা দেখেও অনেকেরই বিশ্বাস হতে চাইবে না, গোটা গুলশানের নামই কোনো এক সময়ে ছিল “ভোলা গ্রাম”।

বিলুপ্ত ভোলা গ্রাম আজ গুলশান হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও ভোলা গ্রামের অস্তিত্ব পুরোপুরি মহাকালের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে যায়নি। গুলশানের স্থানীয় তহশিল অফিসে তল্লাশি চালালে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ভোলা সামাইর’ নামক মৌজার উল্লেখ, যেটিরই বহুল প্রচলিত ডাকনাম ছিল ভোলা গ্রাম।

অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, ভোলা বরিশাল বিভাগের একটি দ্বীপের নাম, যেটি বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে একটি জেলা। তাহলে কি সেই ভোলার সাথে এই ভোলা গ্রামের কোনো যোগসূত্র আছে?

এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচকই হবে। আসলেই ভোলা দ্বীপের সাথে যোগাযোগ রয়েছে ভোলা গ্রামের। এ গ্রামটি যখন মূল ঢাকার বাইরে ছিল, তখন তা ছিল মূলত একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। আর এখানে যারা চাষবাস করত, তাদের অধিকাংশই এসেছিল ভোলা দ্বীপ থেকে। ভোলা দ্বীপের বাসিন্দাদের আধিক্যের কারণেই ঢাকা শহরের মানুষদের মুখে মুখে গ্রামটি ভোলা গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন জাগতে পারে এমনই কি ছিলে ভোলা গ্রাম? এখনকার মতো আধুনিক চোখ ধাঁধানো ও চাকচিক্যময়  কিছু তো নয় অবশ্যই, বরং এটি ছিল গাছপালায় ঘেরা সুনিবিড়, সুনসান নীরব একটি জনপদ। মানুষজনও ছিল নিতান্তই কম। বাইরে থেকেও হাজারো গাড়ী, লাক্ষো মানুষের পদচারণায় মুখোরিত হতো না এ গ্রাম।

রাতে ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসত শেয়ালের ডাক, ঠিক যেমনটি হতো আবহমান গ্রামবাংলার আর দশটা প্রত্যন্ত অঞ্চল। এমনকি ১৯৬৪ সালের দিকে ছোট বাঘ বা মেছো বাঘের দেখা মিলত গুলশানের ঘন বন-জঙ্গলে। ষাটের দশকেও গুলশানে পাখির কলকাকলি আর রাত হলেই পুরো এলাকা হয়ে যেত ঘোর অন্ধকার। আজ যে জায়গায় নিকেতন আবাসিক এলাকার বিস্তৃতি সেটা ছিল দ্বীপ। চারপাশে বৃহৎ জলাশয়। এখানে ঢাকার আশপাশের মানুষ গরু চরাতে আসত।

পাকিস্তানি শাসনামলে ছায়া সুনিবিড় এই গ্রামটির দিকে নজর পড়ে যায় তখনকার ঢাকার ধনাঢ্য সৌখিন মানুষদের। বসবাসের জন্য তারা তো এমনই একটি নিরিবিলি এলাকার খোঁজে ছিল। এদিকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীরও মনে ধরে যায় গ্রামটি। তাই ১৯৬১ সাল নাগাদ গ্রামটিকে অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)-র প্রথম চেয়ারম্যান, পাকিস্তানি আমলা জি এ মাদানি।

এ পর্যায়ে এসে নতুন একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয় এর নাম। একটি গ্রামের নাম না-হয় ভোলা গ্রাম হতেই পারে, কিন্তু সৌখিন, সম্পদশালী মানুষেরা একত্র হয়ে যে আধুনিক উপশহর গড়ে তুলতে চাইছে, সেটির নাম কি আর ‘ভোলা’ রাখা যায়? তাই খোঁজ চলতে থাকে নতুন কোনো ‘আধুনিক’ নামের। এবং শেষমেষ তার সন্ধানও মেলে।

পাকিস্তানের করাচিতে ছিল গুলশান নামের একটি অভিজাত এলাকা। মাদানি সাহেব মনস্থির করেন, ঢাকাস্থ অভিজাত এলাকার নামও রাখা হবে গুলশান, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ফুলের বাগান’। এ ভাবেই আজকের গুলশান “ফুলের বাগান” নামের গোড়াপত্তন হয়। আস্তে আস্তে এখানকার বাসিন্দারা প্রভাবশালীদের চাপে নিজেদের আবাসভূমি ছেড়ে চলে যেতে থাকে। গুলশান নামটি সুন্দর হলেও এর উঁচু উঁচু দালান, ইট পাথরের চাপায় পড়ে আছে এখানকার আদি বাসিন্দদের বুকভাঙ্গা কান্না, দুঃখ-বেদনা, আশা -আকাঙ্খা কত বলা না বলা কথা। অত্যাধুনিকতার রঙে সেসব আজ স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের আতুরঘরে।

ভোলা গ্রামের নাম গুলশান রেখেই ক্ষান্ত হয়নি তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। তারা চেষ্টা চালাতে থাকে নতুন এই গুলশানের চেহারাও হুবহু করাচির গুলশানের মতো করে তোলার। সে উদ্দেশ্যে তখনকার দিনের অভিজাত মানুষেরা মোটা অঙ্কের টাকায় এখানে জমি কিনে এক-দোতলার ছবির মতো সুন্দর সব বাড়ি তৈরি করতে থাকে।

কেউ কেউ আবার বাড়ির সামনেটা সাজিয়ে নেয় গল্প-আড্ডা ও খেলাধুলার উপযোগী করে। অনেকে বাড়ির সামনে গড়ে তোলে ফুলের বাগানও। এভাবেই অভিজাত মানুষদের হাত ধরে গুলশান হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই গুলশান, আর হারিয়ে যেতে থাকে এর প্রাক্তন নামটি। শুধু কি নামটুকুই হারিয়ে যায়? না, একই দশা হয় ভোলা গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ মানুষেরও। গুলশান গড়ে তুলতে গিয়ে তাদের উপর চরম অবিচার করে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। আধুনিক গুলশান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভোলা গ্রামের আদি বাসিন্দাদের কাছ থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হতে থাকে। অথচ তাদেরকে দেয়া হয়নি একটা কানাকড়িও।

আদি বাসিন্দাদের জমির ক্ষেতখামার, পুকুর ভরাট করে আর গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হয় আধুনিক গুলশান। ফলে বাস্তুচ্যুত হয় শত শত পরিবার। তাদের আর মাথা গোজার ঠাঁইটুুকুর পর্যন্ত ছিল না। ফলে তারা ঢাকার অদূরে গাজীপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে।

কিন্তু সেখানেও তারা ছিল বহিরাগত। তাই তাদের অধিকাংশই আর নতুন করে গৃহস্থ হতে পারেনি। ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা দিনমজুরের কাজ করে দিন গুজরান করতে থাকে তারা। আর তাদের উত্তরসূরীদের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। বরং কারো কারো অবস্থা তো আরো করুণ। জীবিকার তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদেরকে।

এদিকে শুরুর দিকে অভিজাত মানুষেরা গুলশানে এসে বাড়ি তৈরি করতে থাকলেও, এর প্রশাসনিক ও কাঠামোগত উন্নয়ন কিন্তু রাতারাতি সম্ভব হয়নি। কারণ গুলশান যখন ভোলা গ্রাম ছিল, তখন এখানে ছিল না আধুনিক জীবনযাপনের প্রায় কিছুই।

তাই ষাটের দশকে ডিআইটি চেয়ারম্যান যখন ভোলা গ্রাম অধিগ্রহণ করে গুলশান বানিয়েছিলেন, সেখানে বাস, সেতু, সড়কবাতি, থানা-পুলিশ, নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজ, বাজার- বলতে গেলে কোনো কিছুই ছিল না। এমনকি লোকজনকে তখন মহাখালী থেকে গুলশান হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। তাই ডিআইটি চেয়ারম্যানের সামনে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল গুলশানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন। সে লক্ষ্যে তিনি এই এলাকার আশেপাশের লেকগুলোকে খনন করে তার মাঝে রেস্তোরাঁ ও রিংরোড বানানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর গুলশানে তিনি একে একে সেতু, বাজার, সড়কবাতি সবকিছুই তৈরি করেন। থানা না হলেও পুলিশ আর্ম ফোর্সের ব্যবস্থা করেন তিনি।

এভাবে ধীরে ধীরে গুলশানের সামগ্রিক উন্নতি সাধিত হতে থাকে। প্রথমে এটি একটি ইউনিয়ন, এবং পরে পৌরসভায় পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে,  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গুলশানসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে গুলশান থানা গঠিত হয়। তবে  ১৯৮২ সালে গুলশানকে প্রথম ঢাকা পৌরসভার একটি ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে ওঠে।

তবে শুরুর দিকের গুলশানের সাথে  বর্তমান গুলশানের আকাশ-পাতাল তফাৎ। নিরিবিলি, ছিমছাম একটি এলাকা ছিল বলেই এটি মন কেড়েছিল অভিজাত মানুষদের। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গুলশান লেকও ছিল তাদের হৃদয় কাড়ার অন্যতম কারণ। একই কারণেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একের পর এক বিদেশী দূতাবাসও গুলশানকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আশির দশকের পর আর এই রূপ ধরে রাখতে পারেনি গুলশান।
শুরুর দিকে প্রায় ১ হাজার তিনশো প্লট ছিল। পুরনো অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা প্রায় দশ ভাগ লোক ছিলেন বাঙালি। গুলশান দুইয়ের ৮০ নম্বর সড়কের কমপক্ষে দশটি বাড়ি এখনও গুলশানের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দোতলা পুরনো বাড়ি, সামনে খোলা লন বা বাগান কিংবা বাড়ির ভেতরে থাকা বড়ো গাছ জানান দেয় সেই পুরনো গুলশানের।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই এই এলাকায় একতলা-দোতলা বাড়ির পরিবর্তে গড়ে উঠতে থাকে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয় গুলশান। পাশাপাশি ঢাকাও তো ক্রমশ গুলশান ছাড়িয়ে আরো উত্তরে বিস্তার লাভ করতে থাকে। সব মিলিয়ে গুলশানের পক্ষেও আর নিজের ইতোপূর্বের সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, বরং সে-ও হয়ে উঠেছে ঢাকা শহরের আরো একটি ব্যস্ততম এলাকা। শুধু নামে আবাসিক এলাকা হলেও, বাণিজ্যিক ভবনের আগ্রাসনে এখন পর্যদুস্ত একসময়কার বনেদি এই এলাকা, যানজট আর শব্দদূষণ যার নিত্যসঙ্গী।

অত্যাধুনিকতা চাপে সেদিনের সুনশান, নিরব নিস্তব্দ গ্রামটির বোবা কান্না কাউকে আর ভাবায় না। দৃষ্টিনন্দন উচু উচু ইমারতের ইট-পাথরে চাপা পড়ে গিয়েছে সে দিনের ভোলা গ্রাম। শুধু দু’একটি স্মৃতি চিহ্ন ছাড়া প্রায় সবই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ভোলা গ্রামের কোনো চিহ্নই চোখে পড়ে না একটি স্কুল ও মসজিদ ছাড়া।

মসজিদটি এখন গুলশান এভিনিউয়ে অবস্থিত এবং ‘গুলশান জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। এর নামফলকে এখনও রয়েছে ভোলা গ্রামের চিহ্ন। সেখানে লেখা সাবেক ভোলা জামে মসজিদ। আনুমানিক ১৮৭৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ গোলাম রসুলের কাছ থেকেই জানা গেল, পাশেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। বিদ্যালয়টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দক্ষিণ বাড্ডায়। নাম ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৫ সাল। গোলাম রসুলের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, জায়গাটির পুরনো বাসিন্দারা এখন আর কেউ নেই। বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ চলে গেছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধার মানিক গ্রামে। সম্ভবতঃ তারা উচ্ছেদ হয়েছেন অথবা নিজেরাই ভোলা গ্রাম থেকে গুলশান হয়ে ওঠার সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়েছেন চলে যেতে। এবং সেই ইতিহাস সুখকর নয়।

যদিও ভোলা গ্রাম বদলে গেছে সহস্রগুণ। এখন সেখানে সড়কে লাল-নিল বাতি জ্বলে। গুলশানের আরও শোভাবর্ধন করছে হাতিরঝিল লেক। রাতের বর্ণিল আলোয় সাজানো লেক পাড়ে যে কেউ ভুলেও কল্পনা করতে পারবেনা এটি এক সময় গ্রাম ছিল। উঁচু উঁচু অট্টালিকার ভিড়ে দেখা যায় না খোলা আকাশ। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে গুলশান আজ ব্যাপক পরিচিত। তাছাড়া গড়ে উঠেছে হোটেল-মোটেল-ক্লাব। গুলশানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত ক্লাব গড়ে উঠলেও সবচেয়ে অভিজাত হলো গুলশান ক্লাব। জিমনেসিয়াম, লাইব্রেরি, সিনেমা হল, সুইমিং পুল অথবা বার কি নেই এখানে? দিনের বেলা সকাল থেকে শারীরিক কসরত আর ব্যায়ামে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে আসেন জ্যেষ্ঠরা। মূলত বিকালের পর থেকে শুরু হয় তরুণ, মাঝ বয়সীদের আনাগোনা। কেতাদুরস্ত পোশাক আর দামী গাড়ি থেকে নামেন ক্লাবের সদস্যরা। রাত অবধি থাকেন ক্লাবে, আড্ডা আর আনন্দে সময় কাটে তাদের। গুলশান ক্লাবের সদস্য হতে আজকাল ১ কোটি থেকে ১ কোটি ৪০/৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়- এমন কথাও শোনা যায়। আজকের গুলশানে অত্যাধুনিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণ  মজুদ থাকলেও সেদিনের ভোলা গ্রামে কল্পনাতীত ছিল।

বিলুপ্ত ভোলা গ্রামের খোঁজ এখন আর গুলশানবাসী রাখেনা। কালের অতলগহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে সেই সব সহজ সরল গ্রাম্য  মানুষের জীবনগাঁথা। ফলে চৈত্রের কাঠ ফাটা তপ্ত কোন এক দুপুরে আন্ধার মানিক থেকে কোন এক বৃদ্ধ যদি গুলশানে ফিরে আসেন, খুঁজে ফেরেন তার পৈতৃক  ভিটা, ফিরে আসেন তার প্রিয় আমগাছের ছায়া তলে। পাবেন কি তার সন্ধান? যদি আমগাছের সন্ধান তিনি পানও, দাবি করার সাহস পাবেন না। করলে তখন তাকেও হয়তো রবি ঠাকুরের সেই ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার মতো চোর বলে অভিজাত মালিকের তাড়া খেতে হবে। সেই বৃদ্ধের জন্য বরাদ্দ রইল এই দুটি পঙ্‌ক্তি:

‘আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।’

ট্যাগস :
আপডেট : ০৭:০০:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২
২৭৯ বার পড়া হয়েছে

ভোলা গ্রাম থেকে আধুনিক গুলশানের ইতিকথা

আপডেট : ০৭:০০:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২

রাজধানী ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোর তালিকা করতে বলা হলে সর্ব প্রথমেই উচ্চারিত হবে গুলশানের নাম। এ যেন ঢাকার বুকে এক টুকরো নিউইয়র্ক, কানাডা  কিংবা লন্ডন।

অত্যাধুনিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে এখানে। রাস্তায় সাধারণ প্রাইভেট কারের চেয়ে হ্যামার, রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, টয়োটা প্রিমিও কিংবা রোলস রয়েসের মতো বিলাসবহুল গাড়িই চোখে পড়ে বেশি, যা এখানকার অধিবাসীদের আর্থিক সামর্থ্যের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো গত শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্তও এই এলাকার না ছিলো অভিজাত দশা, না ছিল এর গালভরা ‘গুলশান’ নামটি। বরং এটি ছিল নিতান্তই একটি অজোপাড়াগাঁ। স্থানীয়রা যাকে  চিনতো ‘ভোলা গ্রাম’ নামে। বর্তমান গুলশানে গিয়ে এ নামের অস্তিত্ব হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সবেধন ‘নাীলমণি’ হিসেবে রয়েছে কেবল দক্ষিণ বাড্ডার “ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”। কিন্তু তা দেখেও অনেকেরই বিশ্বাস হতে চাইবে না, গোটা গুলশানের নামই কোনো এক সময়ে ছিল “ভোলা গ্রাম”।

বিলুপ্ত ভোলা গ্রাম আজ গুলশান হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও ভোলা গ্রামের অস্তিত্ব পুরোপুরি মহাকালের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে যায়নি। গুলশানের স্থানীয় তহশিল অফিসে তল্লাশি চালালে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ভোলা সামাইর’ নামক মৌজার উল্লেখ, যেটিরই বহুল প্রচলিত ডাকনাম ছিল ভোলা গ্রাম।

অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, ভোলা বরিশাল বিভাগের একটি দ্বীপের নাম, যেটি বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে একটি জেলা। তাহলে কি সেই ভোলার সাথে এই ভোলা গ্রামের কোনো যোগসূত্র আছে?

এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচকই হবে। আসলেই ভোলা দ্বীপের সাথে যোগাযোগ রয়েছে ভোলা গ্রামের। এ গ্রামটি যখন মূল ঢাকার বাইরে ছিল, তখন তা ছিল মূলত একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। আর এখানে যারা চাষবাস করত, তাদের অধিকাংশই এসেছিল ভোলা দ্বীপ থেকে। ভোলা দ্বীপের বাসিন্দাদের আধিক্যের কারণেই ঢাকা শহরের মানুষদের মুখে মুখে গ্রামটি ভোলা গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন জাগতে পারে এমনই কি ছিলে ভোলা গ্রাম? এখনকার মতো আধুনিক চোখ ধাঁধানো ও চাকচিক্যময়  কিছু তো নয় অবশ্যই, বরং এটি ছিল গাছপালায় ঘেরা সুনিবিড়, সুনসান নীরব একটি জনপদ। মানুষজনও ছিল নিতান্তই কম। বাইরে থেকেও হাজারো গাড়ী, লাক্ষো মানুষের পদচারণায় মুখোরিত হতো না এ গ্রাম।

রাতে ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসত শেয়ালের ডাক, ঠিক যেমনটি হতো আবহমান গ্রামবাংলার আর দশটা প্রত্যন্ত অঞ্চল। এমনকি ১৯৬৪ সালের দিকে ছোট বাঘ বা মেছো বাঘের দেখা মিলত গুলশানের ঘন বন-জঙ্গলে। ষাটের দশকেও গুলশানে পাখির কলকাকলি আর রাত হলেই পুরো এলাকা হয়ে যেত ঘোর অন্ধকার। আজ যে জায়গায় নিকেতন আবাসিক এলাকার বিস্তৃতি সেটা ছিল দ্বীপ। চারপাশে বৃহৎ জলাশয়। এখানে ঢাকার আশপাশের মানুষ গরু চরাতে আসত।

পাকিস্তানি শাসনামলে ছায়া সুনিবিড় এই গ্রামটির দিকে নজর পড়ে যায় তখনকার ঢাকার ধনাঢ্য সৌখিন মানুষদের। বসবাসের জন্য তারা তো এমনই একটি নিরিবিলি এলাকার খোঁজে ছিল। এদিকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীরও মনে ধরে যায় গ্রামটি। তাই ১৯৬১ সাল নাগাদ গ্রামটিকে অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)-র প্রথম চেয়ারম্যান, পাকিস্তানি আমলা জি এ মাদানি।

এ পর্যায়ে এসে নতুন একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয় এর নাম। একটি গ্রামের নাম না-হয় ভোলা গ্রাম হতেই পারে, কিন্তু সৌখিন, সম্পদশালী মানুষেরা একত্র হয়ে যে আধুনিক উপশহর গড়ে তুলতে চাইছে, সেটির নাম কি আর ‘ভোলা’ রাখা যায়? তাই খোঁজ চলতে থাকে নতুন কোনো ‘আধুনিক’ নামের। এবং শেষমেষ তার সন্ধানও মেলে।

পাকিস্তানের করাচিতে ছিল গুলশান নামের একটি অভিজাত এলাকা। মাদানি সাহেব মনস্থির করেন, ঢাকাস্থ অভিজাত এলাকার নামও রাখা হবে গুলশান, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ফুলের বাগান’। এ ভাবেই আজকের গুলশান “ফুলের বাগান” নামের গোড়াপত্তন হয়। আস্তে আস্তে এখানকার বাসিন্দারা প্রভাবশালীদের চাপে নিজেদের আবাসভূমি ছেড়ে চলে যেতে থাকে। গুলশান নামটি সুন্দর হলেও এর উঁচু উঁচু দালান, ইট পাথরের চাপায় পড়ে আছে এখানকার আদি বাসিন্দদের বুকভাঙ্গা কান্না, দুঃখ-বেদনা, আশা -আকাঙ্খা কত বলা না বলা কথা। অত্যাধুনিকতার রঙে সেসব আজ স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের আতুরঘরে।

ভোলা গ্রামের নাম গুলশান রেখেই ক্ষান্ত হয়নি তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। তারা চেষ্টা চালাতে থাকে নতুন এই গুলশানের চেহারাও হুবহু করাচির গুলশানের মতো করে তোলার। সে উদ্দেশ্যে তখনকার দিনের অভিজাত মানুষেরা মোটা অঙ্কের টাকায় এখানে জমি কিনে এক-দোতলার ছবির মতো সুন্দর সব বাড়ি তৈরি করতে থাকে।

কেউ কেউ আবার বাড়ির সামনেটা সাজিয়ে নেয় গল্প-আড্ডা ও খেলাধুলার উপযোগী করে। অনেকে বাড়ির সামনে গড়ে তোলে ফুলের বাগানও। এভাবেই অভিজাত মানুষদের হাত ধরে গুলশান হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই গুলশান, আর হারিয়ে যেতে থাকে এর প্রাক্তন নামটি। শুধু কি নামটুকুই হারিয়ে যায়? না, একই দশা হয় ভোলা গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ মানুষেরও। গুলশান গড়ে তুলতে গিয়ে তাদের উপর চরম অবিচার করে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। আধুনিক গুলশান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভোলা গ্রামের আদি বাসিন্দাদের কাছ থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হতে থাকে। অথচ তাদেরকে দেয়া হয়নি একটা কানাকড়িও।

আদি বাসিন্দাদের জমির ক্ষেতখামার, পুকুর ভরাট করে আর গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হয় আধুনিক গুলশান। ফলে বাস্তুচ্যুত হয় শত শত পরিবার। তাদের আর মাথা গোজার ঠাঁইটুুকুর পর্যন্ত ছিল না। ফলে তারা ঢাকার অদূরে গাজীপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে।

কিন্তু সেখানেও তারা ছিল বহিরাগত। তাই তাদের অধিকাংশই আর নতুন করে গৃহস্থ হতে পারেনি। ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা দিনমজুরের কাজ করে দিন গুজরান করতে থাকে তারা। আর তাদের উত্তরসূরীদের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। বরং কারো কারো অবস্থা তো আরো করুণ। জীবিকার তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদেরকে।

এদিকে শুরুর দিকে অভিজাত মানুষেরা গুলশানে এসে বাড়ি তৈরি করতে থাকলেও, এর প্রশাসনিক ও কাঠামোগত উন্নয়ন কিন্তু রাতারাতি সম্ভব হয়নি। কারণ গুলশান যখন ভোলা গ্রাম ছিল, তখন এখানে ছিল না আধুনিক জীবনযাপনের প্রায় কিছুই।

তাই ষাটের দশকে ডিআইটি চেয়ারম্যান যখন ভোলা গ্রাম অধিগ্রহণ করে গুলশান বানিয়েছিলেন, সেখানে বাস, সেতু, সড়কবাতি, থানা-পুলিশ, নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজ, বাজার- বলতে গেলে কোনো কিছুই ছিল না। এমনকি লোকজনকে তখন মহাখালী থেকে গুলশান হেঁটে যাতায়াত করতে হতো। তাই ডিআইটি চেয়ারম্যানের সামনে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল গুলশানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন। সে লক্ষ্যে তিনি এই এলাকার আশেপাশের লেকগুলোকে খনন করে তার মাঝে রেস্তোরাঁ ও রিংরোড বানানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর গুলশানে তিনি একে একে সেতু, বাজার, সড়কবাতি সবকিছুই তৈরি করেন। থানা না হলেও পুলিশ আর্ম ফোর্সের ব্যবস্থা করেন তিনি।

এভাবে ধীরে ধীরে গুলশানের সামগ্রিক উন্নতি সাধিত হতে থাকে। প্রথমে এটি একটি ইউনিয়ন, এবং পরে পৌরসভায় পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে,  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গুলশানসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে গুলশান থানা গঠিত হয়। তবে  ১৯৮২ সালে গুলশানকে প্রথম ঢাকা পৌরসভার একটি ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে ওঠে।

তবে শুরুর দিকের গুলশানের সাথে  বর্তমান গুলশানের আকাশ-পাতাল তফাৎ। নিরিবিলি, ছিমছাম একটি এলাকা ছিল বলেই এটি মন কেড়েছিল অভিজাত মানুষদের। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গুলশান লেকও ছিল তাদের হৃদয় কাড়ার অন্যতম কারণ। একই কারণেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একের পর এক বিদেশী দূতাবাসও গুলশানকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আশির দশকের পর আর এই রূপ ধরে রাখতে পারেনি গুলশান।
শুরুর দিকে প্রায় ১ হাজার তিনশো প্লট ছিল। পুরনো অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা প্রায় দশ ভাগ লোক ছিলেন বাঙালি। গুলশান দুইয়ের ৮০ নম্বর সড়কের কমপক্ষে দশটি বাড়ি এখনও গুলশানের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দোতলা পুরনো বাড়ি, সামনে খোলা লন বা বাগান কিংবা বাড়ির ভেতরে থাকা বড়ো গাছ জানান দেয় সেই পুরনো গুলশানের।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই এই এলাকায় একতলা-দোতলা বাড়ির পরিবর্তে গড়ে উঠতে থাকে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয় গুলশান। পাশাপাশি ঢাকাও তো ক্রমশ গুলশান ছাড়িয়ে আরো উত্তরে বিস্তার লাভ করতে থাকে। সব মিলিয়ে গুলশানের পক্ষেও আর নিজের ইতোপূর্বের সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, বরং সে-ও হয়ে উঠেছে ঢাকা শহরের আরো একটি ব্যস্ততম এলাকা। শুধু নামে আবাসিক এলাকা হলেও, বাণিজ্যিক ভবনের আগ্রাসনে এখন পর্যদুস্ত একসময়কার বনেদি এই এলাকা, যানজট আর শব্দদূষণ যার নিত্যসঙ্গী।

অত্যাধুনিকতা চাপে সেদিনের সুনশান, নিরব নিস্তব্দ গ্রামটির বোবা কান্না কাউকে আর ভাবায় না। দৃষ্টিনন্দন উচু উচু ইমারতের ইট-পাথরে চাপা পড়ে গিয়েছে সে দিনের ভোলা গ্রাম। শুধু দু’একটি স্মৃতি চিহ্ন ছাড়া প্রায় সবই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ভোলা গ্রামের কোনো চিহ্নই চোখে পড়ে না একটি স্কুল ও মসজিদ ছাড়া।

মসজিদটি এখন গুলশান এভিনিউয়ে অবস্থিত এবং ‘গুলশান জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। এর নামফলকে এখনও রয়েছে ভোলা গ্রামের চিহ্ন। সেখানে লেখা সাবেক ভোলা জামে মসজিদ। আনুমানিক ১৮৭৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ গোলাম রসুলের কাছ থেকেই জানা গেল, পাশেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। বিদ্যালয়টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দক্ষিণ বাড্ডায়। নাম ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৫ সাল। গোলাম রসুলের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, জায়গাটির পুরনো বাসিন্দারা এখন আর কেউ নেই। বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ চলে গেছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধার মানিক গ্রামে। সম্ভবতঃ তারা উচ্ছেদ হয়েছেন অথবা নিজেরাই ভোলা গ্রাম থেকে গুলশান হয়ে ওঠার সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়েছেন চলে যেতে। এবং সেই ইতিহাস সুখকর নয়।

যদিও ভোলা গ্রাম বদলে গেছে সহস্রগুণ। এখন সেখানে সড়কে লাল-নিল বাতি জ্বলে। গুলশানের আরও শোভাবর্ধন করছে হাতিরঝিল লেক। রাতের বর্ণিল আলোয় সাজানো লেক পাড়ে যে কেউ ভুলেও কল্পনা করতে পারবেনা এটি এক সময় গ্রাম ছিল। উঁচু উঁচু অট্টালিকার ভিড়ে দেখা যায় না খোলা আকাশ। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে গুলশান আজ ব্যাপক পরিচিত। তাছাড়া গড়ে উঠেছে হোটেল-মোটেল-ক্লাব। গুলশানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত ক্লাব গড়ে উঠলেও সবচেয়ে অভিজাত হলো গুলশান ক্লাব। জিমনেসিয়াম, লাইব্রেরি, সিনেমা হল, সুইমিং পুল অথবা বার কি নেই এখানে? দিনের বেলা সকাল থেকে শারীরিক কসরত আর ব্যায়ামে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে আসেন জ্যেষ্ঠরা। মূলত বিকালের পর থেকে শুরু হয় তরুণ, মাঝ বয়সীদের আনাগোনা। কেতাদুরস্ত পোশাক আর দামী গাড়ি থেকে নামেন ক্লাবের সদস্যরা। রাত অবধি থাকেন ক্লাবে, আড্ডা আর আনন্দে সময় কাটে তাদের। গুলশান ক্লাবের সদস্য হতে আজকাল ১ কোটি থেকে ১ কোটি ৪০/৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়- এমন কথাও শোনা যায়। আজকের গুলশানে অত্যাধুনিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণ  মজুদ থাকলেও সেদিনের ভোলা গ্রামে কল্পনাতীত ছিল।

বিলুপ্ত ভোলা গ্রামের খোঁজ এখন আর গুলশানবাসী রাখেনা। কালের অতলগহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে সেই সব সহজ সরল গ্রাম্য  মানুষের জীবনগাঁথা। ফলে চৈত্রের কাঠ ফাটা তপ্ত কোন এক দুপুরে আন্ধার মানিক থেকে কোন এক বৃদ্ধ যদি গুলশানে ফিরে আসেন, খুঁজে ফেরেন তার পৈতৃক  ভিটা, ফিরে আসেন তার প্রিয় আমগাছের ছায়া তলে। পাবেন কি তার সন্ধান? যদি আমগাছের সন্ধান তিনি পানও, দাবি করার সাহস পাবেন না। করলে তখন তাকেও হয়তো রবি ঠাকুরের সেই ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার মতো চোর বলে অভিজাত মালিকের তাড়া খেতে হবে। সেই বৃদ্ধের জন্য বরাদ্দ রইল এই দুটি পঙ্‌ক্তি:

‘আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।’