০৫:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

মাঠ পর্যায়ে সার অপব্যবহারঃ ফসল উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

প্রতিনিধির নাম

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের মাটি বিভিন্ন ভাবে ক্ষয় প্রাপ্ত হওয়ায় মাটির ভৌত গঠনে অবনতি, মাটির জৈব উপাদান এবং উর্ধ্বরাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাই নাশক এবং আগাছা নাশকের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ করি কিন্তু জমির মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নই। মৌসুম, ফসল ও জমিভেদে সারের ব্যবহার ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মাটি পরীক্ষা করে অথবা গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে সরকার নির্ধারিত মাত্রায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী জমিতে সুষম সার ব্যবহার করলে একদিকে যেমন জমির মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে অন্যদিকে খরচ সাশ্রয় হয় এবং ফসলের ফলন বেড়ে যায়। জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার ব্যবহার করলে ফসল আবাদের খরচ বেড়ে যায়, আবার বেশি পরিমাণ সার আমদানি ও কৃষদের নিকট সস্তায় বিক্রয়ের জন্য ভর্তুকি বাবদ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। এছাড়াও অব্যবহৃত সার বৃষ্টি অথবা সেচের পানির সাথে মিশে গিয়ে পানি, মাটি, বায়ু তথা পরিবেশ দূষিত করে। পর্যাপ্ততা, সহজলভ্যতা ও দ্রুত সময়ে রিপোর্ট প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলে সার ব্যবহারের সুফলের ব্যাপারে কৃষকরা অসচেতন হওয়ার কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই জমিতে সার ব্যবহার করে থাকেন।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারে ব্যাপক হারে ভর্তুকী প্রদান করে কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে সার প্রাপ্তি নিশ্চিত করে আসছে। বিগত বছর সমুহে প্রতি বছর সার বাবদ সরকার প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। সারের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর বাংলাদেশ সরকারের এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকায় দাড়িয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবহৃত সার অধিকাংশই বিদেশ হতে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করতে হয়। সুষম সার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার না করার ফলে একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অন্য দিকে সরকারের ব্যাপক পরিমাণ টাকা অপচয় যাচ্ছে। সারের অপচয় রোধ করে ফসলের কাঙ্খিত ফলন প্রাপ্তিতে সুষম সার পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার কৃষকপর্যায়ে জনপ্রিয়করা গেলে সারের অপচয় তথা এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা যাইতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার দাতা সংস্থা এসি আই আর এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন এর যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সুরক্ষা সেবাদানকারী সংগঠন, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশান, পিআইও কনসালটিং লিঃ এবং অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ উদ্যোগে ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলা, রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর ও গোদাগাড়ী উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলা, শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলা, খুলনা জেলার দাকোপ ও ডুমুরিয়া উপজেলা, বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলা এবং পটুয়াখালী উপজেলার দুমকি উপজেলায় ২০১৮ সাল হতে আমন ধান, বোরো ধান, আউশ ধান, গম, ভুট্টা, মসুর, মুগ, সরিষা, ছোলা, বাদাম, সূর্যমুখী, আলু সহ বিভিন্ন ফসলে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারে গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার উপর একটি প্রকল্প বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় ফসলের জন্য পুষ্টি ব্যবস্থাপন নুমান বাস্তবায়ন করে।
এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো

(১)ফসল আবাদে জমিতে পরিমিত ও লাভজনক মাত্রায় সুষম সার প্রয়োগ ও ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ফসল আবাদ করা,
(২)জমির মাটি পরীক্ষা করে অথবা বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশ মালা (এফআরজি) ব্যবহার করে ফসল আবাদে কৃষকদের আগ্রহী ও অভ্যস্ত করা,
(৩)বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশমালা (এফআরজি) কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া,
(৪)স্থানীয় বক বা সাব-বক পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠিত করে ঐ বকের মৌসুম ভিত্তিক ফসল/জাত নির্বাচন করে গ্রুপ ভিত্তিক ফসল আবাদ ও পরিচর্যা কর্মকান্ড পরিচালনা করা,
(৫)সর্বোপরি ফসল আবাদে নিবিড়তা এবং উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থ-সমাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা।

 

প্রকল্পের পার্টনার প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্যোগে ২১ মার্চ ২০২৩ ইং তারিখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অডিটরিয়াম কক্ষে সার নীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রায় ১০০ জন দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী, পলিসি পানার, কৃষি সম্প্রসারণকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও কৃষি মন্ত্রনালয়ের উর্দ্ধতন।
কর্মকর্তাবৃন্দ, কৃষক ও অন্যান্য ব্যক্তি বর্গ উপিস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে কৃষি মন্ত্রনালয়ের মাননীয় সচিব মিসেস ওয়াহিদা আক্তার উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং প্রকল্প লিডার ড. রিচার্ড ডবিঊ বেল এবং অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী সভাপতি ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার।

উল্লিখিত অনুষ্ঠানে নুমান প্রকল্পে বিভিন্ন রিপোর্ট তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায় পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে নুমান প্রকল্প বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের মাঠে বিভিন্ন ফসলের উপর ব্যাপক আকারে কর্মকান্ড পরিচালনা করে। প্রদর্শনী ট্রায়ালের ফলাফল প্রমাণ করে যে, ফসল এবং কৃষক ভেদে সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ ব্যবহার করলে কৃষকের ব্যবহৃত সারের মাত্রা ও প্রকার হতে প্রতি ১ (এক) হেক্টরে প্রতি মৌসুমে টাকা ৩,০০০ ৯,৩০০ সার বাবদ খরচ সাশ্রয় করা যায় এবং ফলনও হেক্টর প্রতি প্রায় ৪৮০ ৬২০ (আমন ধান) কেজি বেশি পাওয়া যায়। এফআরজি অনুসৃত সারের মাত্রা ব্যবহারের ফলে ধান আকারে পুষ্ট হয় এবং উজ্জ্বল রং ধারণ করায় কৃষক ঐ ধান বিক্রয়ের সময় মণ প্রতি অতিরিক্ত টাকা ৫০-১০০ বেশি পায়।

 

নুমান প্রকল্পের গবেষণায় প্রমান হয় যে, সুষম ও পরিমিত সার ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে আমাদের দেশের কৃষকরা সুষম ও পরিমিত মাত্রায় সার ব্যবহারে উদাসীন। অধিকাংশ কৃষক তাঁদের নিকটস্থ কৃষক ও স্থানীয় সার বিক্রেতার পরামর্শ মোতাবেক এবং তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞার আলোকে জমিতে সার প্রয়োগ করে থাকেন। বাজারে অধিকাংশ সারের পর্যাপ্ত যোগান এবং সরকারি ভর্তুকির মুল্যে দামে সস্তা হওয়ার কারণে অনেক কৃষক বেহিসাবি মাত্রায় বেশি পরিমাণ সার ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ টিএসপি সারের পর্যাপ্ত যোগান এবং তুলনামুলক দামে সস্তা হওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরে কৃষক পর্যায়ে এই সারের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতি ৫ (পাঁচ) বছর পর পর বাংলাদেশের কৃষি অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশমালা গাইড (এফআরজি) প্রকাশ করে থাকে। সর্বশেষ প্রকাশকৃত সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ (এফআরজি) অনুসৃত সারের মাত্রা কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আকারে প্রচলন করার জন্য নুমান প্রকল্প ২০২০ সালের শুরুতে কৃষক ব্যবহার বান্ধব, সহজ ও
সাবলীল ভাষায়, তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে এবং প্রায় পরবর্তী ৫ (পাঁচ) বছর সংরক্ষণ ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রধান প্রধান শস্য পরিক্রমায় কৃষি অঞ্চল ভিত্তিক ব্যবহার উপযোগী ১ পাতার এফআরজি কার্ড তৈরি করা করে। প্রকল্পের পার্টনার, পিআইও কনসালটিং লিঃ এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কৃষি সুরক্ষা সেবাদানকারী সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় প্রকল্পের ৮ (আট) টি উপজেলায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কৃষক পরিবারের সকল সদস্যদের মাঝে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল এবং এফআরজি কার্ড ব্যবহার পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত সময়ের প্রশিক্ষণ প্রদান করে মোট ৩৩,০০০ অধিক কৃষক পরিবারকে এফআরজি কার্ড বিতরণ করে।

 

এফআরজি কার্ড বিতরণ পরবর্তী বিভিন্ন মৌসুমের পূর্বে এবং ফসল আবাদকালীন সময়ে প্রত্যেক কৃষকের সাথে ব্যক্তি পর্যায়ে একাধিকবার সাক্ষাত, মাঠ দিবসে আমন্ত্রণ, মোবাইল ফোনে সরাসরি যোগাযোগ এবং এসএমএস, ভয়েজ মেইল, ইমো, হোয়াটসআপ, ফেইসবুক ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে এফআরজি কার্ড মোতাবেক সার ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করা হয়। বার বার ও সহজে পরামর্শ পাওয়ায় কৃষকরা এফআরজি কার্ড ব্যবহারে আগ্রহী হয় ও আস্থা তৈরি হয়। প্রথম মৌসুমে কৃষকরা স্বল্প পরিমাণ জমিতে এফআরজি কার্ড ব্যবহার করে আশানুরূপ ফলন পায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় পরবর্তীতে কৃষকরা তাদের প্রায় সকল জমির ফসলে এফআরজি কার্ড মোতাবেক সার ব্যবহার করেন।

২০২২ সালের শেষের দিকে এফআরজি কার্ড ব্যবহারের ফলাফল তথা কৃষকের লাভ/ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন উপজেলার ১,৫০০ জন কৃষকের মাঝে মূল্যায়ন জরিপ পরিচালনা করা হয়। উক্ত জরিপের ফলাফলে দেখা যায় যে প্রায় ১০০% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহার করে বিগত মৌসুমে ফসল আবাদ করেছেন; ৮৪% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহারে সারের পরিমাণ এবং খরচ সাশ্রয় এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ৯৭% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহার করা সহজ এবং ভবিষ্যতে তাঁরা ব্যবহার করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

ট্যাগস :
আপডেট : ০৩:৫২:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩
১৮৭ বার পড়া হয়েছে

মাঠ পর্যায়ে সার অপব্যবহারঃ ফসল উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

আপডেট : ০৩:৫২:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের মাটি বিভিন্ন ভাবে ক্ষয় প্রাপ্ত হওয়ায় মাটির ভৌত গঠনে অবনতি, মাটির জৈব উপাদান এবং উর্ধ্বরাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাই নাশক এবং আগাছা নাশকের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ করি কিন্তু জমির মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নই। মৌসুম, ফসল ও জমিভেদে সারের ব্যবহার ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মাটি পরীক্ষা করে অথবা গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে সরকার নির্ধারিত মাত্রায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী জমিতে সুষম সার ব্যবহার করলে একদিকে যেমন জমির মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে অন্যদিকে খরচ সাশ্রয় হয় এবং ফসলের ফলন বেড়ে যায়। জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার ব্যবহার করলে ফসল আবাদের খরচ বেড়ে যায়, আবার বেশি পরিমাণ সার আমদানি ও কৃষদের নিকট সস্তায় বিক্রয়ের জন্য ভর্তুকি বাবদ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। এছাড়াও অব্যবহৃত সার বৃষ্টি অথবা সেচের পানির সাথে মিশে গিয়ে পানি, মাটি, বায়ু তথা পরিবেশ দূষিত করে। পর্যাপ্ততা, সহজলভ্যতা ও দ্রুত সময়ে রিপোর্ট প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলে সার ব্যবহারের সুফলের ব্যাপারে কৃষকরা অসচেতন হওয়ার কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই জমিতে সার ব্যবহার করে থাকেন।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারে ব্যাপক হারে ভর্তুকী প্রদান করে কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে সার প্রাপ্তি নিশ্চিত করে আসছে। বিগত বছর সমুহে প্রতি বছর সার বাবদ সরকার প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। সারের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর বাংলাদেশ সরকারের এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকায় দাড়িয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবহৃত সার অধিকাংশই বিদেশ হতে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করতে হয়। সুষম সার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার না করার ফলে একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অন্য দিকে সরকারের ব্যাপক পরিমাণ টাকা অপচয় যাচ্ছে। সারের অপচয় রোধ করে ফসলের কাঙ্খিত ফলন প্রাপ্তিতে সুষম সার পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার কৃষকপর্যায়ে জনপ্রিয়করা গেলে সারের অপচয় তথা এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা যাইতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার দাতা সংস্থা এসি আই আর এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন এর যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সুরক্ষা সেবাদানকারী সংগঠন, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশান, পিআইও কনসালটিং লিঃ এবং অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ উদ্যোগে ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলা, রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর ও গোদাগাড়ী উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলা, শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলা, খুলনা জেলার দাকোপ ও ডুমুরিয়া উপজেলা, বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলা এবং পটুয়াখালী উপজেলার দুমকি উপজেলায় ২০১৮ সাল হতে আমন ধান, বোরো ধান, আউশ ধান, গম, ভুট্টা, মসুর, মুগ, সরিষা, ছোলা, বাদাম, সূর্যমুখী, আলু সহ বিভিন্ন ফসলে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারে গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার উপর একটি প্রকল্প বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় ফসলের জন্য পুষ্টি ব্যবস্থাপন নুমান বাস্তবায়ন করে।
এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো

(১)ফসল আবাদে জমিতে পরিমিত ও লাভজনক মাত্রায় সুষম সার প্রয়োগ ও ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ফসল আবাদ করা,
(২)জমির মাটি পরীক্ষা করে অথবা বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশ মালা (এফআরজি) ব্যবহার করে ফসল আবাদে কৃষকদের আগ্রহী ও অভ্যস্ত করা,
(৩)বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশমালা (এফআরজি) কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া,
(৪)স্থানীয় বক বা সাব-বক পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠিত করে ঐ বকের মৌসুম ভিত্তিক ফসল/জাত নির্বাচন করে গ্রুপ ভিত্তিক ফসল আবাদ ও পরিচর্যা কর্মকান্ড পরিচালনা করা,
(৫)সর্বোপরি ফসল আবাদে নিবিড়তা এবং উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থ-সমাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা।

 

প্রকল্পের পার্টনার প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্যোগে ২১ মার্চ ২০২৩ ইং তারিখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অডিটরিয়াম কক্ষে সার নীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রায় ১০০ জন দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী, পলিসি পানার, কৃষি সম্প্রসারণকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও কৃষি মন্ত্রনালয়ের উর্দ্ধতন।
কর্মকর্তাবৃন্দ, কৃষক ও অন্যান্য ব্যক্তি বর্গ উপিস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে কৃষি মন্ত্রনালয়ের মাননীয় সচিব মিসেস ওয়াহিদা আক্তার উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং প্রকল্প লিডার ড. রিচার্ড ডবিঊ বেল এবং অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী সভাপতি ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার।

উল্লিখিত অনুষ্ঠানে নুমান প্রকল্পে বিভিন্ন রিপোর্ট তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায় পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে নুমান প্রকল্প বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের মাঠে বিভিন্ন ফসলের উপর ব্যাপক আকারে কর্মকান্ড পরিচালনা করে। প্রদর্শনী ট্রায়ালের ফলাফল প্রমাণ করে যে, ফসল এবং কৃষক ভেদে সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ ব্যবহার করলে কৃষকের ব্যবহৃত সারের মাত্রা ও প্রকার হতে প্রতি ১ (এক) হেক্টরে প্রতি মৌসুমে টাকা ৩,০০০ ৯,৩০০ সার বাবদ খরচ সাশ্রয় করা যায় এবং ফলনও হেক্টর প্রতি প্রায় ৪৮০ ৬২০ (আমন ধান) কেজি বেশি পাওয়া যায়। এফআরজি অনুসৃত সারের মাত্রা ব্যবহারের ফলে ধান আকারে পুষ্ট হয় এবং উজ্জ্বল রং ধারণ করায় কৃষক ঐ ধান বিক্রয়ের সময় মণ প্রতি অতিরিক্ত টাকা ৫০-১০০ বেশি পায়।

 

নুমান প্রকল্পের গবেষণায় প্রমান হয় যে, সুষম ও পরিমিত সার ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে আমাদের দেশের কৃষকরা সুষম ও পরিমিত মাত্রায় সার ব্যবহারে উদাসীন। অধিকাংশ কৃষক তাঁদের নিকটস্থ কৃষক ও স্থানীয় সার বিক্রেতার পরামর্শ মোতাবেক এবং তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞার আলোকে জমিতে সার প্রয়োগ করে থাকেন। বাজারে অধিকাংশ সারের পর্যাপ্ত যোগান এবং সরকারি ভর্তুকির মুল্যে দামে সস্তা হওয়ার কারণে অনেক কৃষক বেহিসাবি মাত্রায় বেশি পরিমাণ সার ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ টিএসপি সারের পর্যাপ্ত যোগান এবং তুলনামুলক দামে সস্তা হওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরে কৃষক পর্যায়ে এই সারের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতি ৫ (পাঁচ) বছর পর পর বাংলাদেশের কৃষি অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশমালা গাইড (এফআরজি) প্রকাশ করে থাকে। সর্বশেষ প্রকাশকৃত সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ (এফআরজি) অনুসৃত সারের মাত্রা কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আকারে প্রচলন করার জন্য নুমান প্রকল্প ২০২০ সালের শুরুতে কৃষক ব্যবহার বান্ধব, সহজ ও
সাবলীল ভাষায়, তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে এবং প্রায় পরবর্তী ৫ (পাঁচ) বছর সংরক্ষণ ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রধান প্রধান শস্য পরিক্রমায় কৃষি অঞ্চল ভিত্তিক ব্যবহার উপযোগী ১ পাতার এফআরজি কার্ড তৈরি করা করে। প্রকল্পের পার্টনার, পিআইও কনসালটিং লিঃ এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কৃষি সুরক্ষা সেবাদানকারী সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় প্রকল্পের ৮ (আট) টি উপজেলায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কৃষক পরিবারের সকল সদস্যদের মাঝে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল এবং এফআরজি কার্ড ব্যবহার পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত সময়ের প্রশিক্ষণ প্রদান করে মোট ৩৩,০০০ অধিক কৃষক পরিবারকে এফআরজি কার্ড বিতরণ করে।

 

এফআরজি কার্ড বিতরণ পরবর্তী বিভিন্ন মৌসুমের পূর্বে এবং ফসল আবাদকালীন সময়ে প্রত্যেক কৃষকের সাথে ব্যক্তি পর্যায়ে একাধিকবার সাক্ষাত, মাঠ দিবসে আমন্ত্রণ, মোবাইল ফোনে সরাসরি যোগাযোগ এবং এসএমএস, ভয়েজ মেইল, ইমো, হোয়াটসআপ, ফেইসবুক ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে এফআরজি কার্ড মোতাবেক সার ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করা হয়। বার বার ও সহজে পরামর্শ পাওয়ায় কৃষকরা এফআরজি কার্ড ব্যবহারে আগ্রহী হয় ও আস্থা তৈরি হয়। প্রথম মৌসুমে কৃষকরা স্বল্প পরিমাণ জমিতে এফআরজি কার্ড ব্যবহার করে আশানুরূপ ফলন পায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় পরবর্তীতে কৃষকরা তাদের প্রায় সকল জমির ফসলে এফআরজি কার্ড মোতাবেক সার ব্যবহার করেন।

২০২২ সালের শেষের দিকে এফআরজি কার্ড ব্যবহারের ফলাফল তথা কৃষকের লাভ/ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন উপজেলার ১,৫০০ জন কৃষকের মাঝে মূল্যায়ন জরিপ পরিচালনা করা হয়। উক্ত জরিপের ফলাফলে দেখা যায় যে প্রায় ১০০% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহার করে বিগত মৌসুমে ফসল আবাদ করেছেন; ৮৪% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহারে সারের পরিমাণ এবং খরচ সাশ্রয় এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ৯৭% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহার করা সহজ এবং ভবিষ্যতে তাঁরা ব্যবহার করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।