০৪:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

মানব পাচার : প্রতিরোধের পাশাপাশি চাই সচেতনতা-মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

প্রতিনিধির নাম
পাচার একটি গুরুতর মানবাধিকার লংঘনজনিত অপরাধ। প্রতি বছর অনেক মানুষ পাচারের শিকার হয়। কতজন মানুষ পাচার হয় তা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। কারন পাচার গোপনে সংঘটিত হয়। পাচারকৃত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে দেশিয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক পরিসংখ্যান রয়েছে। জাতিসংঘের মতে প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ পাচার হয়ে থাকে।
পাচার বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তিকে খারাপ ও নিপীড়নের উদ্দেশ্যে , হুমকির মাধ্যমে  অথবা বল প্রয়োগ দ্বারা অথবা কোনো প্রকার দমন-শোষনের মাধ্যমে অপহরন বা প্রতারনা করে ঠকিয়ে অথবা অব্যবস্হার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অথবা লাভ বা অর্থ প্রদান বা গ্রহণ করে একজায়গা থেকে অন্য  জায়গায় অবৈধ স্থানান্তর করা। আন্তর্জাতিক কনভেনশন মতে, মানব পাচার হচ্ছে, মানুষের অধিকারের লংঘন। সেই সাথে এটি ইউরোপীয় ইউনিউনের একটি নির্দেশনার বিষয়বস্তু।
জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে মানব পাচার হলো, ‘ ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা অন্য কোনোভাবে জুলুম, অপহরণ , প্রতারনা, ছলনা, মিথ্যাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে, ভুল বুঝিয়ে , দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অথবা যার ওপরে একজনের কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগসুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষন করার উদ্দেশ্য কাউকে সংগ্রহ , স্থানান্তরিত, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া ‘। এছাড়া ইচ্ছের  বিরুদ্ধে একই শহরে নিজের বাড়ি থেকে অন্য এক জায়গায় যদি কাজে লাগানো হয় তবে সেটাও পাচার বলে গন্য হবে। জাতিসংঘের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে পাচার হওয়া মানুষদের মাঝে ৩৪ শতাংশ নিজ দেশে এবং ৩৭ শতাংশ আন্তঃসীমান্তে পাচার হচ্ছে। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০ জুলাই বিশ্ব মানব পাচার বিরোধী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের অধিকারগুলো প্রচার ও সুরক্ষা এই দিবসের লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেটস্ ২০২০ সালের বৈশ্বিক মানব পাচার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান  ‘দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি তালিকা ‘ থেকে ‘ দ্বিতীয় স্তর’- এ উন্নীত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপগুলোর ফলে গতবছর মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাতটি মানব পাচার ট্রাইবুনাল গঠন এবং বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের শোষনকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ। দ্বিতীয় স্তর-এ অবস্থানের অর্থ হলো, পাচার নির্মুলের লক্ষ্যে ন্যূনতম মান অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান প্রচেস্টা নিচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩ ) এর ৫ ধারানুসারে নারী পাচার বলতে বোঝায়, যদি কোনো ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনি কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্য কোনো নারীকে বিদেশ হতে আনেন বা বিদেশে প্রেরণ করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন বা অনুরূপ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে তার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন। এই আইনের ৬ ধারানুসারে৷ শিশু পাচার বলতে বোঝায়, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বেআইনি উদ্দেশ্যে  কোনো শিশুকে বিদেশ হতে আনেন বা বিদেশে প্রেরণ করেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা উক্তরুপ কোনো উদ্দেশ্যে  কোনো শিশুকে নিজ দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন। পাচার আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে অথবা দেশের সীমানার মধ্যেও হতে পারে।
মানব পাচার ও প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৩ ধারানুসারে মানব পাচার অর্থ কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ করে বা প্রতারনা করে বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা লেনদেনপূর্বক উক্ত ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষন বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষন বা অন্য কোনো শোষন বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেওয়া।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হিসেবে বছরের পর বছর ব্যবহার হয়ে আসছে। মানব পাচারের দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগর একটি আন্তরাষ্ট্রীয় রুটে পরিনত হয়েছে। এ পথে মুলতঃ বাংলাদেশ ও  মায়ানমার থেকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য মানব পাচার হয়। থাইল্যান্ড মানব পাচারের এক শক্তিশালী রুট। থাইল্যান্ডে পাচারকৃত নারী ও শিশুদের যৌন কাজে বাধ্য করা হয়। মালয়েশিয়াতে বিভিন্ন অনুন্নত দেশের নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়ে থাকে। তাদেরকে জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হয়।
নারী ও শিশু পাচার একটি জঘন্য অপরাধ যা সংঘটিত  হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকাশ পায়না। এটা তখনই  প্রকাশ পায় যখন পাচারের শিকার বিপন্ন ব্যক্তিরা দেশে বা বিদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় বা অজানা স্হানে গিয়ে কঠিন দুর্দশার মুখোমুখি হয়। সীমান্ত এলাকার অধিবাসীদের পাশবর্তী দেশের সাথে যোগাযোগ থাকে,  তাই সীমান্ত পারাপার তাদের জন্য কোনো নতুন বিযয় নয়।এবং এই পারাপারের সময়েও তারা পাচারের শিকার হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের  লোকজন বিশেষ করে মহিলারা বিদেশের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে, বিক্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি জায়গায় চাকরি পেয়ে থাকে। সহজেই লাভজনক চাকরি প্রাপ্তির এই জাতীয় উদাহরণ গরীব বাবা-মাকে  তাদের কন্যা ও শিশুদের বিদেশে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। এই চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকেই অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে পাচারের শিকার হয়
পাচারকারীরা বিভিন্ন পথে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। যেমন – জল, স্হল ও আকাশপথ।বাংলাদেশ থেকে পাচারের যে উদাহরণগুলো পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় আকাশ পথে কিছু পাচার হয়, তবে স্হলপথে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই বেশি সংখ্যক নারী ও শিশু পাচার হয়। বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৪,২২২ কিমি এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮ কিমি সীমান্ত এলাকা রয়েছে। পাচারকারীরা পাচারকৃত নারী ও শিশুদের বিভিন্ন ক্ষতি ও নিপীড়নমুলক কাজে নিয়োজিত করে। যেমন – পতিতাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, রক্ষিতা, বাধ্যতামুলক শ্রম, যৌনদাসী , ক্রীতদাস, কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ন শ্রম, উটের জকি ইত্যাদি।  পাচারের উদ্দেশ্যে সংগৃহীত নারী ও শিশু সংগ্রহের সময় থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট স্হানে ও দেশে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এবং পরে বিভিন্ন ধরনের মানসিক , শারীরিক  এবং পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়।
দারিদ্র্যকে মানব পাচারের প্রধান কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, যে সকল দেশ থেকে পাচার হয় তার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। এ অবস্থায় তাদের কাছে একটি ভাল জীবনের প্রতিশ্রুতি সেটা যতই অবাস্তব হোক না কেন তা পাচারের  ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। কিছু ব্যক্তি তাদের চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য পাচারের মতো ক্ষতিকর পরিস্হিতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।পাচারকারীরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে থাকে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশেধনী ২০০৩ )  এর ৫(১) ধারানুসারে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে নারীকে বিদেশ থেকে আনা বা পাচার অথবা ক্রয়- বিক্রয় করলে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনধিক বিশবছর অনুন্য দশবছর কারাদণ্ড হবে। ৫(২) ধারানুসারে, পতিতালয়ে নারীকে বিক্রয় করা হলে উপধারা (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। ৫(৩) ধারানুসারে  কোনো নারীকে পতিতা হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ক্রয় করলে, দখলে নিলে, জিম্মায় রাখলে উপধারা (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩ )  এর ৬(১) ধারানুসারে নীতি বহির্গত কাজের উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে বিদেশ থেকে আনা বা বিদেশে পাচার অথবা ক্রয়-বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে  দখলে রাখলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড  এবং অর্থদন্ড হবে। ৬(২) ধারানুসারে নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, শিশু বা মাতৃসদন,  নার্সিংহোম, ক্লিনিক ইত্যাদি বা সংশ্লিষ্ট  শিশুর হেফাজত থেকে চুরি করলে উক্ত ব্যক্তির উপধান (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। ৭ ধারানুসারে যদি কেনো ব্যক্তি ধারা ৫ এর উল্লেখিত অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ব্যতিত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে। ৮ ধারানুসারে কোনো ব্যক্তি মুক্তিপন আদায়ের উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে আটক করলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড, বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে।
মানব পাচার ও প্রতিরোধ দমন আইন, ২০১২ এর ৬ ধারানুসারে মানব পাচারের শাস্তি অনধিক যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং অনুন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনুন্য ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ধারা ৭ অনুসারে সংঘবদ্ধ  পাচারের শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড  বা অনুন্য ৭ বছর এবং অনুন্য ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড। ধারা ৮  অনুসারে অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা প্রচেষ্টা চালানোর শাস্তি অনধিক ৭বছর এবং  অনুন্য ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনুন্য ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ধারা ৯ অনুসারে জবরদস্তি বা দাসত্বমুলক শ্রম বা সেবা প্রদান করতে বাধ্য করার শাস্তি অনধিক  ১২ বছর এবং অনুন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। ১০ ধারানুসারে মানব পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরণ , চুরি এবং আটক করার শাস্তি অনধিক ১০ বছর এবং অনুন্য ৫ বছর কারাদণ্ড এবং অনুন্য ৫০ হাজার টাক অর্থদণ্ড।
১১ ধারানুসারে পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো প্রকারের যৌন শোষন বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের শাস্তি ৭ বছর এবং অনুন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড সহ অনুন্য ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ১২ ধারানুসারে পরিচালনা বা স্হানকে পতিতালয় হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের শাস্তি অনধিক  ৫ বছর এবং অনুন্য ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। ১৩ ধারানুসারে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে আহবান জানানোর শাস্তি  অনধিক ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ১৫ ধারানুসারে  মিথ্যা  মামলা বা মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের শাস্তি  অনধিক ৫ বছর এবং অনুন্য ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।
মানব পাচার ও প্রতিরোধ দমন আইন , ২০১২ অনুসারে  সরকার মাবব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ, উদ্ধার প্রত্যাবাসন এবং পুনর্বাসনকল্পে সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি সংস্থাসমুহের সাথে অংশীদারত্বে কাজ করবেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিশেষত: নারী ও শিশুদের কল্যান ও বিশেষ চাহিদার দিকে লক্ষ রাখবেন। কোনো বাংলাদেশি নাগরিক অন্য কোনো দেশে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হলে সরকার সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের এবং প্রয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় উক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত আনার ব্যবস্হা করবেন। বিদেশি রাষ্ট্রে মানব পাচারের শিকার কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রে থাকতে বাধ্য হলে বাংলাদেশ দুতাবাস উক্ত ব্যক্তিকে আইনি পরামর্শ বা সহায়তা প্রদানের ব্যবস্হা করবেন। অনুরূপভাবে কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হলে সরকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দূতাবাসের সহযোগিতায় উক্ত ব্যক্তিকে তার স্বদেশে পাঠানোর ব্যবস্হা করবেন।
উদ্ধার হবার পর মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিকে স্বীয় পরিবারে ফেরত পাঠানো না হলে কোনো সরকারি বা বেসরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রেরন করতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের অনুমতি ছাড়া মানব পাচারের শিকার কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্যদের নাম,ছবি বা তথ্য বা পরিচয় প্রচার বা সম্প্রচার করতে পারবে না। এই বিধান লংঘনকারী ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ অর্থদণ্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। প্রত্যেক পাচারের শিকার ব্যক্তি বা সাক্ষী তার প্রতি হুমকি প্রদর্শিত হলে বা যে কোনো প্রকার ঝুঁকির আশঙ্কা সৃষ্টি  হলে পুলিশি নিরাপত্তা পাবার এবং সরকার কর্তৃক প্রদেয় অন্যান্য সুরক্ষামুলক ব্যবস্হার অধিকারী হবেন।
সরকার মানব পাচার শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। এই উদ্দেশ্যে প্রচলিত আইনের আলোকে নানা বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার , ফিরিয়ে আনার পর পুনর্বাসন ও সুরক্ষা দেবে সরকার। তাছাড়া মানব পাচারের মামলাগুলোর তথ্য সংরক্ষণে একটি ডাটাবেইজ তৈরি হবে যার মধ্যে মানব পাচারের শিকার প্রত্যেক ভিক্টিমের জন্য সতন্ত্র কোড নাম্বার সম্বলিত একটি ফাউল তৈরি ও সংরক্ষণ করা হবে। বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
নারী ও শিশু পাচারের মতো সমস্যা ও তার প্রতিকার কোনো ব্যক্তি বা বাহিনীর পক্ষে এককভাবে  সমাধা করা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী,  বিভিন্ন বেসরকারি সামাজিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে একত্রিত ও উদ্বুদ্ধ করে নারী ও শিশু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে  সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নারী ও শিশুদের নিরাপদ করতে হলে পাচারকারীদের শক্ত হাতে দমন ও নির্মুল করা প্রয়োজন। নারী ও শিশু পাচাররোধ করার জন্য বর্তমান সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে পাচার প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা।
ট্যাগস :
আপডেট : ০২:১২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ মে ২০২২
২৫৫ বার পড়া হয়েছে

মানব পাচার : প্রতিরোধের পাশাপাশি চাই সচেতনতা-মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

আপডেট : ০২:১২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ মে ২০২২
পাচার একটি গুরুতর মানবাধিকার লংঘনজনিত অপরাধ। প্রতি বছর অনেক মানুষ পাচারের শিকার হয়। কতজন মানুষ পাচার হয় তা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। কারন পাচার গোপনে সংঘটিত হয়। পাচারকৃত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে দেশিয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক পরিসংখ্যান রয়েছে। জাতিসংঘের মতে প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ পাচার হয়ে থাকে।
পাচার বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তিকে খারাপ ও নিপীড়নের উদ্দেশ্যে , হুমকির মাধ্যমে  অথবা বল প্রয়োগ দ্বারা অথবা কোনো প্রকার দমন-শোষনের মাধ্যমে অপহরন বা প্রতারনা করে ঠকিয়ে অথবা অব্যবস্হার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অথবা লাভ বা অর্থ প্রদান বা গ্রহণ করে একজায়গা থেকে অন্য  জায়গায় অবৈধ স্থানান্তর করা। আন্তর্জাতিক কনভেনশন মতে, মানব পাচার হচ্ছে, মানুষের অধিকারের লংঘন। সেই সাথে এটি ইউরোপীয় ইউনিউনের একটি নির্দেশনার বিষয়বস্তু।
জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে মানব পাচার হলো, ‘ ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা অন্য কোনোভাবে জুলুম, অপহরণ , প্রতারনা, ছলনা, মিথ্যাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে, ভুল বুঝিয়ে , দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অথবা যার ওপরে একজনের কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগসুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষন করার উদ্দেশ্য কাউকে সংগ্রহ , স্থানান্তরিত, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া ‘। এছাড়া ইচ্ছের  বিরুদ্ধে একই শহরে নিজের বাড়ি থেকে অন্য এক জায়গায় যদি কাজে লাগানো হয় তবে সেটাও পাচার বলে গন্য হবে। জাতিসংঘের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে পাচার হওয়া মানুষদের মাঝে ৩৪ শতাংশ নিজ দেশে এবং ৩৭ শতাংশ আন্তঃসীমান্তে পাচার হচ্ছে। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০ জুলাই বিশ্ব মানব পাচার বিরোধী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের অধিকারগুলো প্রচার ও সুরক্ষা এই দিবসের লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেটস্ ২০২০ সালের বৈশ্বিক মানব পাচার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান  ‘দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি তালিকা ‘ থেকে ‘ দ্বিতীয় স্তর’- এ উন্নীত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপগুলোর ফলে গতবছর মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাতটি মানব পাচার ট্রাইবুনাল গঠন এবং বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের শোষনকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ। দ্বিতীয় স্তর-এ অবস্থানের অর্থ হলো, পাচার নির্মুলের লক্ষ্যে ন্যূনতম মান অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান প্রচেস্টা নিচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩ ) এর ৫ ধারানুসারে নারী পাচার বলতে বোঝায়, যদি কোনো ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনি কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্য কোনো নারীকে বিদেশ হতে আনেন বা বিদেশে প্রেরণ করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন বা অনুরূপ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে তার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন। এই আইনের ৬ ধারানুসারে৷ শিশু পাচার বলতে বোঝায়, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বেআইনি উদ্দেশ্যে  কোনো শিশুকে বিদেশ হতে আনেন বা বিদেশে প্রেরণ করেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা উক্তরুপ কোনো উদ্দেশ্যে  কোনো শিশুকে নিজ দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন। পাচার আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে অথবা দেশের সীমানার মধ্যেও হতে পারে।
মানব পাচার ও প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৩ ধারানুসারে মানব পাচার অর্থ কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ করে বা প্রতারনা করে বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা লেনদেনপূর্বক উক্ত ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষন বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষন বা অন্য কোনো শোষন বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেওয়া।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হিসেবে বছরের পর বছর ব্যবহার হয়ে আসছে। মানব পাচারের দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগর একটি আন্তরাষ্ট্রীয় রুটে পরিনত হয়েছে। এ পথে মুলতঃ বাংলাদেশ ও  মায়ানমার থেকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য মানব পাচার হয়। থাইল্যান্ড মানব পাচারের এক শক্তিশালী রুট। থাইল্যান্ডে পাচারকৃত নারী ও শিশুদের যৌন কাজে বাধ্য করা হয়। মালয়েশিয়াতে বিভিন্ন অনুন্নত দেশের নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়ে থাকে। তাদেরকে জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হয়।
নারী ও শিশু পাচার একটি জঘন্য অপরাধ যা সংঘটিত  হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকাশ পায়না। এটা তখনই  প্রকাশ পায় যখন পাচারের শিকার বিপন্ন ব্যক্তিরা দেশে বা বিদেশে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় বা অজানা স্হানে গিয়ে কঠিন দুর্দশার মুখোমুখি হয়। সীমান্ত এলাকার অধিবাসীদের পাশবর্তী দেশের সাথে যোগাযোগ থাকে,  তাই সীমান্ত পারাপার তাদের জন্য কোনো নতুন বিযয় নয়।এবং এই পারাপারের সময়েও তারা পাচারের শিকার হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের  লোকজন বিশেষ করে মহিলারা বিদেশের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে, বিক্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি জায়গায় চাকরি পেয়ে থাকে। সহজেই লাভজনক চাকরি প্রাপ্তির এই জাতীয় উদাহরণ গরীব বাবা-মাকে  তাদের কন্যা ও শিশুদের বিদেশে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। এই চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকেই অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে পাচারের শিকার হয়
পাচারকারীরা বিভিন্ন পথে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। যেমন – জল, স্হল ও আকাশপথ।বাংলাদেশ থেকে পাচারের যে উদাহরণগুলো পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় আকাশ পথে কিছু পাচার হয়, তবে স্হলপথে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই বেশি সংখ্যক নারী ও শিশু পাচার হয়। বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৪,২২২ কিমি এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮ কিমি সীমান্ত এলাকা রয়েছে। পাচারকারীরা পাচারকৃত নারী ও শিশুদের বিভিন্ন ক্ষতি ও নিপীড়নমুলক কাজে নিয়োজিত করে। যেমন – পতিতাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, রক্ষিতা, বাধ্যতামুলক শ্রম, যৌনদাসী , ক্রীতদাস, কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ন শ্রম, উটের জকি ইত্যাদি।  পাচারের উদ্দেশ্যে সংগৃহীত নারী ও শিশু সংগ্রহের সময় থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট স্হানে ও দেশে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এবং পরে বিভিন্ন ধরনের মানসিক , শারীরিক  এবং পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়।
দারিদ্র্যকে মানব পাচারের প্রধান কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, যে সকল দেশ থেকে পাচার হয় তার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। এ অবস্থায় তাদের কাছে একটি ভাল জীবনের প্রতিশ্রুতি সেটা যতই অবাস্তব হোক না কেন তা পাচারের  ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। কিছু ব্যক্তি তাদের চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য পাচারের মতো ক্ষতিকর পরিস্হিতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।পাচারকারীরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে থাকে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশেধনী ২০০৩ )  এর ৫(১) ধারানুসারে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে নারীকে বিদেশ থেকে আনা বা পাচার অথবা ক্রয়- বিক্রয় করলে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনধিক বিশবছর অনুন্য দশবছর কারাদণ্ড হবে। ৫(২) ধারানুসারে, পতিতালয়ে নারীকে বিক্রয় করা হলে উপধারা (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। ৫(৩) ধারানুসারে  কোনো নারীকে পতিতা হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ক্রয় করলে, দখলে নিলে, জিম্মায় রাখলে উপধারা (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩ )  এর ৬(১) ধারানুসারে নীতি বহির্গত কাজের উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে বিদেশ থেকে আনা বা বিদেশে পাচার অথবা ক্রয়-বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে  দখলে রাখলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড  এবং অর্থদন্ড হবে। ৬(২) ধারানুসারে নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, শিশু বা মাতৃসদন,  নার্সিংহোম, ক্লিনিক ইত্যাদি বা সংশ্লিষ্ট  শিশুর হেফাজত থেকে চুরি করলে উক্ত ব্যক্তির উপধান (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। ৭ ধারানুসারে যদি কেনো ব্যক্তি ধারা ৫ এর উল্লেখিত অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ব্যতিত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে। ৮ ধারানুসারে কোনো ব্যক্তি মুক্তিপন আদায়ের উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে আটক করলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড, বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে।
মানব পাচার ও প্রতিরোধ দমন আইন, ২০১২ এর ৬ ধারানুসারে মানব পাচারের শাস্তি অনধিক যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং অনুন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনুন্য ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ধারা ৭ অনুসারে সংঘবদ্ধ  পাচারের শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড  বা অনুন্য ৭ বছর এবং অনুন্য ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড। ধারা ৮  অনুসারে অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা প্রচেষ্টা চালানোর শাস্তি অনধিক ৭বছর এবং  অনুন্য ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনুন্য ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ধারা ৯ অনুসারে জবরদস্তি বা দাসত্বমুলক শ্রম বা সেবা প্রদান করতে বাধ্য করার শাস্তি অনধিক  ১২ বছর এবং অনুন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। ১০ ধারানুসারে মানব পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরণ , চুরি এবং আটক করার শাস্তি অনধিক ১০ বছর এবং অনুন্য ৫ বছর কারাদণ্ড এবং অনুন্য ৫০ হাজার টাক অর্থদণ্ড।
১১ ধারানুসারে পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো প্রকারের যৌন শোষন বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের শাস্তি ৭ বছর এবং অনুন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড সহ অনুন্য ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ১২ ধারানুসারে পরিচালনা বা স্হানকে পতিতালয় হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের শাস্তি অনধিক  ৫ বছর এবং অনুন্য ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। ১৩ ধারানুসারে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে আহবান জানানোর শাস্তি  অনধিক ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।  ১৫ ধারানুসারে  মিথ্যা  মামলা বা মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের শাস্তি  অনধিক ৫ বছর এবং অনুন্য ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।
মানব পাচার ও প্রতিরোধ দমন আইন , ২০১২ অনুসারে  সরকার মাবব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ, উদ্ধার প্রত্যাবাসন এবং পুনর্বাসনকল্পে সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি সংস্থাসমুহের সাথে অংশীদারত্বে কাজ করবেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিশেষত: নারী ও শিশুদের কল্যান ও বিশেষ চাহিদার দিকে লক্ষ রাখবেন। কোনো বাংলাদেশি নাগরিক অন্য কোনো দেশে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হলে সরকার সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের এবং প্রয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় উক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত আনার ব্যবস্হা করবেন। বিদেশি রাষ্ট্রে মানব পাচারের শিকার কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রে থাকতে বাধ্য হলে বাংলাদেশ দুতাবাস উক্ত ব্যক্তিকে আইনি পরামর্শ বা সহায়তা প্রদানের ব্যবস্হা করবেন। অনুরূপভাবে কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হলে সরকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দূতাবাসের সহযোগিতায় উক্ত ব্যক্তিকে তার স্বদেশে পাঠানোর ব্যবস্হা করবেন।
উদ্ধার হবার পর মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিকে স্বীয় পরিবারে ফেরত পাঠানো না হলে কোনো সরকারি বা বেসরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রেরন করতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের অনুমতি ছাড়া মানব পাচারের শিকার কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্যদের নাম,ছবি বা তথ্য বা পরিচয় প্রচার বা সম্প্রচার করতে পারবে না। এই বিধান লংঘনকারী ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ অর্থদণ্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। প্রত্যেক পাচারের শিকার ব্যক্তি বা সাক্ষী তার প্রতি হুমকি প্রদর্শিত হলে বা যে কোনো প্রকার ঝুঁকির আশঙ্কা সৃষ্টি  হলে পুলিশি নিরাপত্তা পাবার এবং সরকার কর্তৃক প্রদেয় অন্যান্য সুরক্ষামুলক ব্যবস্হার অধিকারী হবেন।
সরকার মানব পাচার শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। এই উদ্দেশ্যে প্রচলিত আইনের আলোকে নানা বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার , ফিরিয়ে আনার পর পুনর্বাসন ও সুরক্ষা দেবে সরকার। তাছাড়া মানব পাচারের মামলাগুলোর তথ্য সংরক্ষণে একটি ডাটাবেইজ তৈরি হবে যার মধ্যে মানব পাচারের শিকার প্রত্যেক ভিক্টিমের জন্য সতন্ত্র কোড নাম্বার সম্বলিত একটি ফাউল তৈরি ও সংরক্ষণ করা হবে। বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
নারী ও শিশু পাচারের মতো সমস্যা ও তার প্রতিকার কোনো ব্যক্তি বা বাহিনীর পক্ষে এককভাবে  সমাধা করা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী,  বিভিন্ন বেসরকারি সামাজিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে একত্রিত ও উদ্বুদ্ধ করে নারী ও শিশু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে  সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নারী ও শিশুদের নিরাপদ করতে হলে পাচারকারীদের শক্ত হাতে দমন ও নির্মুল করা প্রয়োজন। নারী ও শিশু পাচাররোধ করার জন্য বর্তমান সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে পাচার প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা।