০৩:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

সখীপুরে সোনালী ধানে মহামারী আকার ধারণ করেছে ব্লাস্ট, দিশেহারা কৃষক 

প্রতিনিধির নাম
দিগন্তজুরা ধান আর ধান। বুঝতে বাকি নেই ইরি-বোরোতে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। ধানে ভরে যাবে কৃষকের গোলা। শত কষ্টেও সোনালী ধান ভুলিয়ে দিবে সব। কিন্তু বিধিবাম বোরোর এ ভরা মৌসুমে হঠাৎ করেই ব্লাস্ট রোগের হানা।
 “মুনে অয় খেতের ধান পাকছে। খেতে যাইয়া দেহি হগল ধান চিট্যা। বেলাস্ট রোগে নাকি হগল ধান খাইয়া ফালাইছে। অহন আমরা কী করমু। ভরা (অনেক) টেহা খরচা অইছে। ৫০ মুন ধানের মুধ্যে ৫ মুনও পামু না।’
গত বুধবার বোয়ালী গ্রামের আবদুর রহমান নামের এক কৃষক পরামর্শের জন্য সখীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে এসে কর্মকর্তা পর্যায়ের কাউকে না পেয়ে অফিস সহকারীর সঙ্গে রাগ দেখালেন এবং এ কথাগুলো তিনি বললেন।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে আবদুর রহমানের মতো শত শত কৃষকের বোরো ধানের খেত ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁদের স্বপ্ন ভেঙে যেতে বসেছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, ব্রি-২৮ জাতের ধানে এ রোগ বেশি হয়। উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে কৃষকদের নিয়ে প্রতিটি সভায় এ জাতের ধান রোপণে কৃষকদের নিষেধ করা হয়। এরপরও উপজেলার কৃষকেরা ব্রি-২৮ জাতের ধান ৭ হাজার ৬৮৫ হেক্টর জমিতে রোপণ করেছেন।
এ ব্যাপারে উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘কৃষককে এ রোগ থেকে সচেতন করতে কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। সময়মতো বিকেল বেলা ওষুধ স্প্রে করলে এ রোগ থেকে বাঁচা যায়। আমাদের প্রচারে কৃষক যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। গত মৌসুমে ব্রি-২৮ জাতের ধান ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। আর এবার আবাদ কম হয়েছে।’
ব্লাস্ট রোগ নিয়ে স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রচারপত্র পড়ে জানা যায়, ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত ভীষণ ক্ষতিকারক রোগ। এ রোগ ছোঁয়াচে। ব্লাস্ট তিন ধরনের। এর মধ্যে নেকব্লাস্ট (ঘাড় মটকানো) শেষ সময়ে ধানের শিষে আক্রমণ করে। শিশির বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সময় ধানের ডিগপাতা ও শিষের গোড়ার সংযুক্ত স্থানে পানি জমে ব্লাস্টের জীবাণু আক্রমণ করে। পরে আক্রান্ত শিষের গোড়া পচে যাওয়ায় গাছের খাবার শিষে যেতে পারে না। ফলে শিষ শুকিয়ে বাদামি রং ধারণ করে দানা চিটা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ৯৫ থেকে ১০০ ভাগ ফলন কমে যেতে পারে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলার প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৬৮৫ হেক্টর জমিতে। তবে ব্রি-২৮ জাতের ধান যেখানে রোপণ করা হয়, সেই খেতেই এ রোগ আক্রমণ করেছে। উপজেলা আটটি ইউনিয়নেই কমবেশি এ রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে।
গত বুধবার বেলা ১১টায় উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের নয়া কচুয়া, দক্ষিণ কচুয়া, দেবরাজ, বানিয়ারসিট, আড়াইপাড়া, কুতুবপুর, বড়চওনা ঘুরে দেখা যায়, ব্লাস্টের আক্রমণে ধানখেত পুড়ে গেছে। ধানের শিষ থাকলে সেগুলো চিটা হয়েছে। এ সময় কথা হয় দক্ষিণ কচুয়া গ্রামের কৃষক আশরাফ আলী, ইসমাইল, বুলবুল আহমেদ, নয়া কচুয়া গ্রামের জোয়াহের আলী, আবু বকর, আবদুল গফুর, হায়দার আলী, দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ‘আমরা জানতাম না যে ব্রি-২৮ ধানের ওপর কৃষি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা বংশপরম্পরায় এ ধান বুনে আসছি। এ ধানের ফলনও খুবই ভালো।’
 নয়া কচুয়া গ্রামের কৃষক জোয়াহের আলী বলেন, ‘আমি ১ একর জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপণ করেছি। আশা করেছিলাম না হলেও ৫০-৬০ মণ ধান পাব। ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করায় ১০ মণ ধানও পাওয়া যাবে না।’ কালিয়া ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো.হোসাইন আহমেদ বলেন, ‘আমি এখনো কচুয়া গ্রামে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছি। আমি নিষেধ করার পরও কৃষকেরা আমাদের পরামর্শ না শুনে ব্রি-২৮ ধান রোপণ করেছেন।’
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত)  আয়েশা আক্তার বলেন, ‘সাধারণত ব্রি-২৮ জাতের ধানে অপেক্ষাকৃত বেশি ও ব্রি-২৯ জাতের ধানে অপেক্ষাকৃত কমএ রোগটি আক্রমণ করে। কৃষকদের এ জাতের ধান রোপণে বারবার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমি আমার কার্যালয়ের সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করেছি। প্রতিটি ইউনিয়নে স্কোয়াড গঠন করে দিয়েছি। সরকারি ছুটির দিনেও মাঠে মাঠে গিয়ে আমার স্টাফরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করলে ও সময়মতো ওষুধ স্প্রে করলে এ রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।’
ট্যাগস :
আপডেট : ০৫:০১:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৩
৫৯ বার পড়া হয়েছে

সখীপুরে সোনালী ধানে মহামারী আকার ধারণ করেছে ব্লাস্ট, দিশেহারা কৃষক 

আপডেট : ০৫:০১:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৩
দিগন্তজুরা ধান আর ধান। বুঝতে বাকি নেই ইরি-বোরোতে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। ধানে ভরে যাবে কৃষকের গোলা। শত কষ্টেও সোনালী ধান ভুলিয়ে দিবে সব। কিন্তু বিধিবাম বোরোর এ ভরা মৌসুমে হঠাৎ করেই ব্লাস্ট রোগের হানা।
 “মুনে অয় খেতের ধান পাকছে। খেতে যাইয়া দেহি হগল ধান চিট্যা। বেলাস্ট রোগে নাকি হগল ধান খাইয়া ফালাইছে। অহন আমরা কী করমু। ভরা (অনেক) টেহা খরচা অইছে। ৫০ মুন ধানের মুধ্যে ৫ মুনও পামু না।’
গত বুধবার বোয়ালী গ্রামের আবদুর রহমান নামের এক কৃষক পরামর্শের জন্য সখীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে এসে কর্মকর্তা পর্যায়ের কাউকে না পেয়ে অফিস সহকারীর সঙ্গে রাগ দেখালেন এবং এ কথাগুলো তিনি বললেন।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে আবদুর রহমানের মতো শত শত কৃষকের বোরো ধানের খেত ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁদের স্বপ্ন ভেঙে যেতে বসেছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, ব্রি-২৮ জাতের ধানে এ রোগ বেশি হয়। উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে কৃষকদের নিয়ে প্রতিটি সভায় এ জাতের ধান রোপণে কৃষকদের নিষেধ করা হয়। এরপরও উপজেলার কৃষকেরা ব্রি-২৮ জাতের ধান ৭ হাজার ৬৮৫ হেক্টর জমিতে রোপণ করেছেন।
এ ব্যাপারে উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘কৃষককে এ রোগ থেকে সচেতন করতে কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। সময়মতো বিকেল বেলা ওষুধ স্প্রে করলে এ রোগ থেকে বাঁচা যায়। আমাদের প্রচারে কৃষক যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। গত মৌসুমে ব্রি-২৮ জাতের ধান ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। আর এবার আবাদ কম হয়েছে।’
ব্লাস্ট রোগ নিয়ে স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রচারপত্র পড়ে জানা যায়, ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত ভীষণ ক্ষতিকারক রোগ। এ রোগ ছোঁয়াচে। ব্লাস্ট তিন ধরনের। এর মধ্যে নেকব্লাস্ট (ঘাড় মটকানো) শেষ সময়ে ধানের শিষে আক্রমণ করে। শিশির বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সময় ধানের ডিগপাতা ও শিষের গোড়ার সংযুক্ত স্থানে পানি জমে ব্লাস্টের জীবাণু আক্রমণ করে। পরে আক্রান্ত শিষের গোড়া পচে যাওয়ায় গাছের খাবার শিষে যেতে পারে না। ফলে শিষ শুকিয়ে বাদামি রং ধারণ করে দানা চিটা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ৯৫ থেকে ১০০ ভাগ ফলন কমে যেতে পারে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলার প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৬৮৫ হেক্টর জমিতে। তবে ব্রি-২৮ জাতের ধান যেখানে রোপণ করা হয়, সেই খেতেই এ রোগ আক্রমণ করেছে। উপজেলা আটটি ইউনিয়নেই কমবেশি এ রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে।
গত বুধবার বেলা ১১টায় উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের নয়া কচুয়া, দক্ষিণ কচুয়া, দেবরাজ, বানিয়ারসিট, আড়াইপাড়া, কুতুবপুর, বড়চওনা ঘুরে দেখা যায়, ব্লাস্টের আক্রমণে ধানখেত পুড়ে গেছে। ধানের শিষ থাকলে সেগুলো চিটা হয়েছে। এ সময় কথা হয় দক্ষিণ কচুয়া গ্রামের কৃষক আশরাফ আলী, ইসমাইল, বুলবুল আহমেদ, নয়া কচুয়া গ্রামের জোয়াহের আলী, আবু বকর, আবদুল গফুর, হায়দার আলী, দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ‘আমরা জানতাম না যে ব্রি-২৮ ধানের ওপর কৃষি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা বংশপরম্পরায় এ ধান বুনে আসছি। এ ধানের ফলনও খুবই ভালো।’
 নয়া কচুয়া গ্রামের কৃষক জোয়াহের আলী বলেন, ‘আমি ১ একর জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপণ করেছি। আশা করেছিলাম না হলেও ৫০-৬০ মণ ধান পাব। ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করায় ১০ মণ ধানও পাওয়া যাবে না।’ কালিয়া ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো.হোসাইন আহমেদ বলেন, ‘আমি এখনো কচুয়া গ্রামে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছি। আমি নিষেধ করার পরও কৃষকেরা আমাদের পরামর্শ না শুনে ব্রি-২৮ ধান রোপণ করেছেন।’
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত)  আয়েশা আক্তার বলেন, ‘সাধারণত ব্রি-২৮ জাতের ধানে অপেক্ষাকৃত বেশি ও ব্রি-২৯ জাতের ধানে অপেক্ষাকৃত কমএ রোগটি আক্রমণ করে। কৃষকদের এ জাতের ধান রোপণে বারবার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমি আমার কার্যালয়ের সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করেছি। প্রতিটি ইউনিয়নে স্কোয়াড গঠন করে দিয়েছি। সরকারি ছুটির দিনেও মাঠে মাঠে গিয়ে আমার স্টাফরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করলে ও সময়মতো ওষুধ স্প্রে করলে এ রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।’