সোমবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ০৯:২১ পূর্বাহ্ন
মাত্র ৪০ দিন বয়সে বাবাকে এবং ২০ দিন পরে ৬০ দিন বয়সে মাকে হারিয়ে বড় দুই বোনসহ চিরতরে এতিম হয়েছে বাবু। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে উত্তর সর্দারপাড়া গ্রামে। এতে মর্মাহত ও শোকাবহ অবস্থা বিরাজ করছে ওই এলাকায়। চারদিকে বিরাজ করছে শোকের ছায়া। শোকে কাতর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন।
মাত্র পাঁচ বছর দাম্পত্য জীবনে দুই কন্যা সন্তানের পর ঘর আলোকিত করে জন্ম হয়েছিল বংশের প্রদীপ খ্যাত এক পুত্র সন্তানের। জন্ম হয়েছে মাত্র তাই ছেলের নামও রাখা হয়নি। মনে মনে বাবা ঠিক করে রেখেছিলেন একমাত্র ছেলের ডাক নাম রাখবেন বাবু’। বাবার ইচ্ছে ছিল খুব ধূমধাম করে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ছেলের আকিকা করিয়ে ইসলামি শরিয়ত মাফিক নাম রাখবেন। তাই একমাত্র পুত্র সন্তানের আকিকার প্রায় সব আয়োজনও ছিল শেষের দিকে। বাবার জীবন শেষ হয়ে গেল কিন্তু ছেলের আকিকা আর করা হলো না।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার লক্ষীপুর এলাকায় ট্রাক ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত একরামুলের ইচ্ছে ছিল একমাত্র পুত্র সন্তানের আকিকা করাবেন। নিহত একরামুল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের উত্তর সর্দারপাড়া গ্রামের নাসিরউদ্দিনের ছেলে ছিল। তিনি অলিম্পিক কোম্পানিতে পঞ্চগড় জেলা শাখায় মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কাজ করতেন।
ওইদিন আকিকার বিষয়ে আলোচনা শেষে শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরার পথেই শেষ হয়ে যায় তার জীবন ও ছেলেকে ঘিরে বুনা স্বপ্ন। একরামের নিহতের দিনে ছেলের বয়স ছিল মাত্র ৪০ দিন। সন্তানের জন্য আকিকা না করিয়েই সে না ফেরার ওই অচিন দেশের রাজ্যে চিরকালের জন্য পাড়ি জমান|
এদিকে স্বামীর অবর্তমানে শোকে কাতর হয়ে দিন কাটতে থাকেন একরামের স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক পুত্র এবং বৃদ্ধ মা বাবা।
তার দুই কন্যা শিশু এখনো কোন স্কুলে যায়না। বড় জনের নাম নূরে জান্নাত তার বসয় কেবলই সাড়ে চার। দ্বিতীয় জনের নাম উম্মে সুরাইয়া তারও বয়স মাত্র দেড় বছর। আর পুত্রের বয়স ৬০ দিন মাত্র।
কথায় আছে, “ভাগ্যের লিখন কখনো খন্ডন করা যায়না”। অনেকে বাবা মা থাকা সত্বেও এতিমখানায় থাকে, আবার কেউ কেউ পেটের দায়ে সন্তানও পর্যন্ত বিক্রি করে, অনেকে আবার কত যুগ ধরে সন্তানের মুখ দেখেনা আবার কেউ কেউ দত্তক চাইতেই সন্তান পায়না। অথবা দুনিয়ায় এটাই ঘটে থাকে যে, হয় পুত্র পিতার খাটিয়া বহন করবে না হয় পিতাই পুত্রের খাটিয়ে বহন করে গোরস্থানে নিয়ে যাবে। কিন্তু একরামের বেলায় তা ঘটলনা। পুত্রের মাত্র ৪০ দিন বসয় থাকাবস্থায় সে সড়ক দুর্ঘটনায় উপারে পারি জমান।
এদিকে স্ত্রী লাবনী বেগম স্বামীর মৃত্যুর রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তারও জীবনের ঘনঘটা শেষ হয়ে এলো বলে| স্বামী শোক সইতে গিয়ে নিজেই ভেঙ্গে পরেন। তিন সন্তানকে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বামীর শেষ ইচ্ছে মতো পুত্র সন্তানের আকিকাও করার মনস্থ করেছিলেন। নিজেকে তিন সন্তানের বাবা এবং মা হিসেবেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তারপরও মাঝে মাঝে স্বামীর শূন্যতায় তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরতেন এই ভেবে যে, তিন সন্তানকে কেমন করে মানুষের মতো মানুষ বানাবেন।
কিন্তু সন্তানদের নিয়ে তার এই ভাবনাও যেন বিধাতা সইলেন না। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ঠান্ডা জনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পরেন স্ত্রী লাবনী বেগম। ওই দিনেই ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ পত্র সেবন করেন। ১৯ তম দিনেও অল্প অসুস্থ ছিলেন তিনি। কিন্তু ছোট ওই তিন ভাই বোনের কপাল থেকে হয়তো সৃষ্টিকর্তা বাবা মা ডাকটা মুছে ফেলবেন এটাই ছিল তার নিয়তি। আর তাই তো ২০ তম দিনে অর্থ্যাৎ বাবার মৃত্যুর ২০ দিনের মাথায় গত ৫ জানুয়ারি মা’কে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেলে নূরে জান্নাত, উম্মে সুরাইয়া ও বাবু। আর কখনো ডাকতে পারবেনা বাবা ও মাকে। মা বাবা কেবলই শুধু অনুভূতি, সৃতি ও ছবিই হয়ে থাকবে আর সবার অগোচরে ঝড়বে চোখ থেকে নোনা জল। বাবা ম শুধুই হয়ো থাকবেন বিশাল আকাশের তাঁরা হিসেবে। নেমে আসবে হয়তো কোন এক রাত্রির স্বপ্নদেশে।
মাত্র ৪০ দিন বয়সে বাবা ও ২০ দিন পর ৬০ দিন বয়সে মা’কে হারিয়েছে অবুজ শিশু Ôবাবু’। তাই একবার ওই অবুজ তিন শিশুদের ও মা লাবনীর লাশ দেখতে এলাকায় ভীর করেছে হাজারো মানুষ। পুরো এলাকায় নেমেছে শোকের ছায়া। সকলেই ঘরে ফিরেছে অশ্রুসিক্ত চোখে।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একরামুলের বাবা, মা ও বড় ভাই এখনো বেচে রয়েছেন। বড় ভাইয়ের নাম আশরাফুল ইসলাম। পেশায় তিনিও একজন কৃষক। তারও দুই সন্তান রয়েছে। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর ২০ দিনের মধ্যেই তার বউয়ের মৃত্যুর বিষয়টি তিনিও মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে ছোট ভাইয়ের রেখে যাওয়া ফুটফুটে ৬০ দিনের পুত্র সন্তানসহ দুই মেয়ের জন্য তার বেশি কষ্ট হচ্ছে। এত অল্প বয়সে বাবা মা দুজনকেই হারিয়ে এতিম হবে সেটা অভাবনীয় ছিল। তিনি জানান, তার দুই সন্তানসহ ছোট ভাইয়ের তিন সন্তানকে তিনি একাই নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করবেন|
বর্তমানে ওই তিন শিশু পার্শ্ববর্তী লক্ষীপুর গ্রামের নানা সহিদুল ইসলামের বাড়িতে রয়েছে।