০১:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

ঘুরে এলাম অপার সৌন্দর্যে ঘেরা মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালি

প্রতিনিধির নাম

আষাঢ়ের প্রথম দিন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ প্রচন্ড শোঁ শোঁ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটি যেন নড়েচড়ে উঠছে বারবার। কী ব্যাপার কালবৈশাখী শুরু হয়েছে নাকি ! এখনতো আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে, এসয় রাজধানী ঢাকাতে প্রচন্ড তাপমাত্রা, কখনো কখনো ৩৫-৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়, জনজীবন অতিষ্ঠ। দরজা খুলে বাইরে দাঁড়াতেই হাড় কাঁপুনি শীতে সমস্ত শরীর হীম হয়ে এলো। দরজা বন্ধ করে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল মেঘ যেন ছোট্ট কাঠের ঘরটিকে ঘিরে ধরে আছে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে তাই জেগে উঠলাম তাড়াহুড়া করে, তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো, গেঞ্জি পরে বাইরে দাঁড়াতেই, এক অদ্ভুত সৌন্দর্য অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য, গা ঘেঁষে আলতো স্পর্শ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো সারি সারি মেষ, মনে হচ্ছিলো আমি যেন মেষের মাঝে ভেষে বেড়াচ্ছি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিশ্রাম নিচ্ছে ছন্নছাড়া মেঘের দল। পুব আকাশে সবে আবির মাখতে শুরু করেছে। শরীর হীম হয়ে যাওয়া বাতাস ছুয়ে যাচ্ছিলো শরীরটায়। অপরূপ সকালটি সঙ্গে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি মেঘের উপর বাড়ি সাজিয়ে, সাজেকে।

গিয়েছিলাম মেঘ-পাহাড়ের সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেকে। একদম হুট করে নয়, একরকম প্লান করে। আমি দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি প্রায় ৭/৮ বছর হয়। সাংবাদিক হিসেবে ব্যস্ততায় দিন কাটে। পরিবারে সময় দিতে পারি না বললেই চলে। মাঝে মাঝে মনে হতো কোথাও নিরিবিলি ঘুরে আসি। আর সে সুযোগটাও হয়ে যায়। গত বছর অক্টোবর ২০২২ ছিলো বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার ৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। পেশাগত দক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বোচ্চ সম্মাননাস্বরূপ সপরিবারে বিমানযোগে ঢাকা-চট্রগ্রাম যাওয়ার সুযোগটা হয়ে গেলো, যা বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে হয়ে উঠছিলো না। আমার মেয়ে দুটিও বার বার তাড়া করছিলো কবে ঘুরতে যাবে। ওরা নিজেরাই আলোচনা করে ঠিক করে নিয়েছে সাজেক যাবে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। গত মাসে দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার সম্পাদক ড. খান আসাদুজ্জামান পিভিএমএস স্যার বাংলাদেশ বিমানের চারটি টিকেট কেটে আনলেন, ১৫ জুন ২০২৩ বাংলাদেশ বিমানে স্ব- পরিবারে চট্রগ্রাম যাওয়ার। টিকেট পেয়ে খুব খুশি লাগলো। টিকেট কাটার পর থেকে আমার ছোট মেয়ে ফাইজা রহমান রিমির খুশি আর ধরে না। আমার দুই মেয়ে বড় মেয়ে ফারজিন রহমান প্রমি ও ছোট মেয়ে ফাইজা রহমান রিমি। বড়টার চেয়ে ছোটটা খুব চটপটে। সাজেক যাওয়ার কথা শুনে সেদিন থেকে দিন গুনতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এলো সাজেক যাওয়ার সময়। মাত্র একদিন বাকী, এর আগে সম্পাদক স্যার আমার পরিবারের সবাইকে অফিসে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকেট দিয়েছেন, দুপুরে লাঞ্চ করিয়েছেন, এমনকি থাকা খাওয়ার খরচও দিয়েছেন। আমার সব কিছুতে তিনি অত্যন্ত আন্তরিক, একজন সম্পূর্ণ অবিভাবকের দ্বায়িত্ব পালন করেন।

১৫ জুন ২০২৩, সকাল ৭.৪৫ মি. বাংলাদেশ বিমানে আমরা চট্রগ্রাম যাবো। ফজরের নামাজ পড়ে আমরা তৈরি হচ্ছিলাম, স্যার ফোন করে বললেন, জাহিদ সাহেব আমি আপনাদের জন্য গাড়ি নিয়ে কমলাপুর অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি আসেন। আমরা তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লাম। এই প্রথম আমি বিমানে কোথাও যাচ্ছি, তিনি আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। সমস্ত চেক ও বেডিং পাস করে আমরা গিয়ে বিমানে উঠলাম, এক নতুন অভিজ্ঞতা, এই প্রথম বিমানে ওঠা। বিমান যখন মেঘের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো, অন্যরকম  একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো যা বুঝাতে পারবো না। ৪০/৪৫ মিনিটের মধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে একটি সিএনজি নিয়ে অক্সিজেন মোড় চলে গেলাম। কোন রকম সকালের নাস্তা করে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। খাগড়াছড়ি হতে সাজেক যাওয়ার গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। অফিসের কলিগ মো. ছাব্বির হোসাইন অত্যন্ত সুন্দর মনের একজন মানুষ।  পূর্বে সাজেক গিয়েছে তাই সমস্ত পথঘাট চেনা। আমি সাজেক যাবো শুনেই ওর পরিচিত ড্রাইভার মো. রফিকুল ইসলামকে বলে অন্য একজন ড্রাইভার ও হোটেল বুকিং করে দিলো। ড্রাইভার রমজান বার বার কল করছিলো আমরা কখন পৌছাবো জানার জন্য। খাগড়াছড়ি পৌছাতে পৌনে দুইটা বেজে গেলো। ড্রাইভার রমজান তাড়াতাড়ি ল্যাগেজ গাড়িতে উঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দুরত্ব ৪৫ কি. মি.। আমরা যখন বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌছাই তখন বেলা ২টা ৪৫ মি.। এখান থেকে আর্মি বিডিয়ারের যৌথ প্রহরায় পর্যটকদের গাড়ি বহর সাজেক নিয়ে যাওয়া হয়। ড্রাইভার রমজান আমাদেরকে গাড়ীতে রেখে চেক পোস্ট-এ গিয়ে জানালো গাড়ী পথে লেট করেছে তাই সময় মতো আসতে পারেনি, যেহেতু আমরা ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে এসেছি তাই টোকেন দিয়ে যেতে বললেন। পাহাড়ি পথ গাড়ী খুব সাবধানে চালাতে হয়। কখনো ১৫০/২০০ ফুট পাহাড়ে উঠে আবার নীচে নামতে হয়। মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছিলো নাজানি কখন গাড়ি উল্টে খাদে পড়ে যায়। পথে যেতে চোখে পড়লো সারি সারি আমগাছ, গাছগুলো যেন আমের ডিসপ্লে। পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে জুম চাষের প্রক্রিয়া চলছিলো। উঁচু উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে, সুন্দর চটুল ছন্দে বয়ে চলছে নদী।৷ এখানকার বড় নদীগুলোর মধ্যে হলো চেঙ্গি, মাইনি ও মাচালং। মাচালং নদীটির উৎপত্তি স্থল ভারতের ত্রিপুরা। পথে যেতে চোখে পড়লো মাচালং, মাঘাইছড়ি, দিঘিনালা, টাইগার টিলা আর্মি ক্যাম্প। রয়েছে ভারতের উদয়পুর বর্ডার। আর্মি, বিডিয়ার ক্যাম্পগুলি যেন সদাজাগ্রত ও নিরাপত্তা বিধানে ব্যস্ত।  সাজেকের আদিবাসিন্দা হলো চাকমা, লুসাই ও ত্রিপুরা ইত্যাদি। এরা মূলতো ভারতের অধিবাসী, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, যে অংশ বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে সে অঞ্চলে এরা থেকে যায়। আজকের পাহাড়ি অঞ্চল এমন নিরাপদ ও ভীতিহীন কখনোই ছিলো না। পাহাড়িরা নিজেদের  আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করে আসছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের এ দাবি মেনে না নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহ ও শান্তিচুক্তির মাধ্যমে স্বস্তির অবস্থা ফিরে এসেছে। এ এলাকায় বাঙালিদের বসবাস শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। একসময় ঘনঅরণ্যে পরিপূর্ণ  ছিলো । তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ এ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের আহবান জানালে বিভিন্ন এলাকা হতে লোক এসে বনজঙ্গল পরিস্কার করে বসতি স্থাপন করে। আস্তে আস্তে বাঙালিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। আলাপচারীতায় জানতে পারলাম ড্রাইভার রমজানের পূর্বপুরুষ এসেছিল ময়মনসিংহ থেকে।  রাস্তার পাশে দেখা যাচ্ছিলো আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘর। এক অপূর্ব মহিমায় যেন মহান রাব্বুল আলামিন সৃষ্টি করেছেন এই পাহাড় নদী, যেন সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মেষ যেন পাহাড়ের গায় চুম্বন একে লেগে রয়েছে। পাহাড়, নদী আর গাছাপালা দেখতে আমরা পৌছে গেলাম সাজেকে।

সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। দিন দিন ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে সাজেকের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে তাই সরকার  সাজেককে থানায় রূপান্তরিত করেছেন। এর ফলে এ এলাকার জনগণ আগের চেয়ে অনেকটা নিরাপদ। উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা অবস্থিত। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি যেন এক প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ। যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ, এ যেন বাংলাদেশের দার্জিলিং।  প্রকৃতি এখানে সকাল বিকাল রঙ বদলায়। কখনো ঝলমলে আলো আবার হঠাৎ মেঘে ছেয়ে যায়। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে। মেঘ এসে যেন হাতের কাছে ধরা দেয়। কেউ না গেলে সাজেকের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা কল্পনাও করতে পারবে না।

থাকার কটেজের বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম ১৫ দিন আগে। আমরা যখন সাজেক পৌছাই তখন বেলা সাড়ে পাঁচটা। সুন্দর ছিমছাম কাঠের ঘর, টিনের ছাউনি, একরুমে দুটি খাট বিছানো রয়েছে। দক্ষিণে বিশাল বারান্দা। শিল্পীর তুলিতে আঁকা যেন নিপুণ ছবি। নাম অধরা রিসোর্ট। যেহেতু আমাদের ভ্রমণের সময় স্বল্প তাই ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাজেক জিরো পয়েন্টে গেলাম, কিছু সময় ঘোরাঘুরি করে নাস্তা করলাম। সবচেয়ে আকর্ষণ হলো বাশেঁর কাপে চা পান। এরপর রুমে গিয়ে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম, কিছু কেনাকাটা  করলাম। এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো রুমে চলে এলাম। এখানে খাবার হোটেলগুলোর আলাদা একটা বৈচিত্র, খাবার খেতে হলে ২/৩ ঘটা আগে অর্ডার করতে হয়। রুম সার্ভিস ছেলেটাকে ডেকে খাবারের অর্ডার করলাম। এখানকার খাবেরের মূল আকর্ষণ হলো ব্যাম্বো চিকেন বিরিয়ানি। বাঁশের মধ্যে চিকেন, মসলাও রাইস দিয়ে আগুনে বাঁশ পুড়িয়ে এ খাবার রান্না করা হয়। এটি অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। ১০টার মধ্যে খাবার এলো রাতের খাবার খেলাম। সারাদিন অনেক পথ জার্নি  করার কারণে খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কখনো মেঘের এতো কাছ থেকে বৃষ্টি উপভোগ করিনি, মনে হচ্ছিলো মেঘ যেনো আমাদের কটেজের উপরেই এসে পড়েছে । বৃষ্টির পাশাপাশি প্রচুর ঠান্ডা অনুভব হচ্ছিলো। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলাম, এসম ঢাকা শহরের তাপমাত্রা ৩৫-৪০ ডিগ্রি থাকে। আর এখানে  শীত লাগায় খুব ভালোই লাগছিলো।  ফজরের নামাজ পড়ে বাইরে তাকাতেই অপূর্ব সৌন্দর্য চোখে পড়লো। মেঘগুলো যেন জানালা দিয়ে উঁকি মারছিলো। তখনো রিমিঝিম বৃষ্টি হচ্ছিলো। মেয়ে দুটোকে ডেকে উঠালাম ওরা বেলকুনিতে গিয়ে নাচলো গান করলো। এর পর আমরা ল্যাগেজ গুছিয়ে  নাস্তা করার জন্য বের হলাম। হোটেলে ঢুকতেই প্রচন্ড বৃষ্টি  হলো। ভেবেছিলাম নাস্তা করে কংলাক পাহাড় দেখতে যাবো, বৃষ্টির কারণে তা পন্ড হয়ে গেলো।

নাস্তা করে আবার গাড়িতে উঠলাম, সাজেক ক্যাম্পে টিকেট কেটে খাগড়াছড়ির পথে রওনা হলাম। খাগড়াছড়ি এসেছি কিন্তু আলু টিলা পাহাড়, আলুটিলা গুহা, ঝুলন্ত ব্রীজ, রিসাং ঝর্ণা দেখবো না তাকি হয়। দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকা আসার জন্য রাত ১০.৩০ মিনিটে হানিফ গাড়ির ৩টি টিকিট কাটলাম। আবার  যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমে গেলাম রিসাং ঝর্ণা দেখতে, এটি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত। ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। গাড়ী রেখে মেয়েদের নিয়ে ঝর্ণা দেখতে চললাম, প্রায় হাফ কিলোমিটার হেটে ঝর্ণার কাছে গেলাম এখান থেকে ১০০ ফুটের বেশি সিড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। মেয়েরা যেতে পারলেও স্ত্রী আসমাকে নীচে নামাতে কষ্ট হলো, এমনিতে সে ডায়াবেটিসের রোগী। তাই অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়, তারপরও যুদ্ধে এসে রনে ভঙ্গ দিলেতো চলে না। কোনমতে সবাইকে নিয়ে ঝর্ণা দেখলাম, আকাশে প্রচুর মেঘ, তাড়াহুড়ো করে উপরে চলে এলাম। কোনমতে হাটতে পারছিলো না, তাই স্ত্রী আসমাকে একটি মোটরসাইকেলে উঠিয়ে দিলাম, কষ্ট হবে ভেবে ছোট মেয়ে রিমিকে পাঠিয়ে দিলাম। বড় মেয়ে প্রমিকে নিয়ে আমি হেটে হেটে গাড়ির কাছে এলাম আবার যাত্রা শুরু, এবার গন্তব্য ঝুলন্ত ব্রীজ ও আলুটিলা গুহা। গাড়ি থেকে নেমে মেয়েদের নিয়ে নীচে নামতে থাকলাম প্রায় ১০/১২ মিনিট নীচে নামার পর গুহার সন্ধান পেলাম। গুহাটির দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট, অন্ধকার ও কর্দমাক্ত তাই মেয়েদের বায়না সত্বেও ভিতরে প্রবেশ করলাম না। ভিতরে অক্সিজেন সমস্যা হতে পারে ভেবে গুহার সামনে তিন জনের পিক  তুললাম। এরপর ঝুলন্ত ব্রীজে  উঠলাম ছবি তুললাম। এরমধ্যে বেলা শেষ সন্ধে হয়ে এলো, হালকা নাস্তা করে, আবার যাত্রা করলাম এবার কোন দর্শনীয় স্থান নয়, সোজা খাগড়াছড়ি শহরে হানিফ কাউন্টারে। ল্যাগেজ নামিয়ে কাউন্টারে রেখে রমজান ভাইকে ভাড়া দিলাম। খুব সুন্দর ও ভালো মনের মানুষ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, ভালো লাগছিলো না, ভাবলাম সাংবাদিক মনির উদ্দিন মুন্নাকে কল করি। সজিবের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কল করলাম। মুন্না ভাই স্ত্রী-বাচ্চাসহ এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন। সবাই মিলে নাস্তা করলাম। মুন্না ভাই রাত ৯.৩০ মিনিট পর্যন্ত থেকে চলে গেলেন। রাত ১১টায় খাগড়াছড়ি হতে গাড়ি ছাড়লো সারাদিন পাহাড়ে হেটে সবাই ক্লান্ত। অনেক স্মৃতি ও আনন্দ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলাম। তখনও মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো সাজেক, সাদা মেঘের অপরূপ সৌন্দর্য, লুসাই পল্লী, কংলাক পাহাড়, উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তা, আলুটিলা, রিসাং ঝর্ণা, অন্ধকার গুহা, পাহাড় থেকে সমস্ত খাগড়াছড়িকে দেখা, মনে হচ্ছিলো  আমরা আরেক নতুন স্থানে ঘুরতে যাচ্ছি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কল্পনাও করতে পারছি না।

ট্যাগস :
আপডেট : ০৪:৫৩:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুন ২০২৩
৮৪ বার পড়া হয়েছে

ঘুরে এলাম অপার সৌন্দর্যে ঘেরা মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালি

আপডেট : ০৪:৫৩:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুন ২০২৩

আষাঢ়ের প্রথম দিন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ প্রচন্ড শোঁ শোঁ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরটি যেন নড়েচড়ে উঠছে বারবার। কী ব্যাপার কালবৈশাখী শুরু হয়েছে নাকি ! এখনতো আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে, এসয় রাজধানী ঢাকাতে প্রচন্ড তাপমাত্রা, কখনো কখনো ৩৫-৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়, জনজীবন অতিষ্ঠ। দরজা খুলে বাইরে দাঁড়াতেই হাড় কাঁপুনি শীতে সমস্ত শরীর হীম হয়ে এলো। দরজা বন্ধ করে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল মেঘ যেন ছোট্ট কাঠের ঘরটিকে ঘিরে ধরে আছে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে তাই জেগে উঠলাম তাড়াহুড়া করে, তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো, গেঞ্জি পরে বাইরে দাঁড়াতেই, এক অদ্ভুত সৌন্দর্য অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য, গা ঘেঁষে আলতো স্পর্শ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো সারি সারি মেষ, মনে হচ্ছিলো আমি যেন মেষের মাঝে ভেষে বেড়াচ্ছি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিশ্রাম নিচ্ছে ছন্নছাড়া মেঘের দল। পুব আকাশে সবে আবির মাখতে শুরু করেছে। শরীর হীম হয়ে যাওয়া বাতাস ছুয়ে যাচ্ছিলো শরীরটায়। অপরূপ সকালটি সঙ্গে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি মেঘের উপর বাড়ি সাজিয়ে, সাজেকে।

গিয়েছিলাম মেঘ-পাহাড়ের সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেকে। একদম হুট করে নয়, একরকম প্লান করে। আমি দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি প্রায় ৭/৮ বছর হয়। সাংবাদিক হিসেবে ব্যস্ততায় দিন কাটে। পরিবারে সময় দিতে পারি না বললেই চলে। মাঝে মাঝে মনে হতো কোথাও নিরিবিলি ঘুরে আসি। আর সে সুযোগটাও হয়ে যায়। গত বছর অক্টোবর ২০২২ ছিলো বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার ৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। পেশাগত দক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বোচ্চ সম্মাননাস্বরূপ সপরিবারে বিমানযোগে ঢাকা-চট্রগ্রাম যাওয়ার সুযোগটা হয়ে গেলো, যা বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে হয়ে উঠছিলো না। আমার মেয়ে দুটিও বার বার তাড়া করছিলো কবে ঘুরতে যাবে। ওরা নিজেরাই আলোচনা করে ঠিক করে নিয়েছে সাজেক যাবে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। গত মাসে দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার সম্পাদক ড. খান আসাদুজ্জামান পিভিএমএস স্যার বাংলাদেশ বিমানের চারটি টিকেট কেটে আনলেন, ১৫ জুন ২০২৩ বাংলাদেশ বিমানে স্ব- পরিবারে চট্রগ্রাম যাওয়ার। টিকেট পেয়ে খুব খুশি লাগলো। টিকেট কাটার পর থেকে আমার ছোট মেয়ে ফাইজা রহমান রিমির খুশি আর ধরে না। আমার দুই মেয়ে বড় মেয়ে ফারজিন রহমান প্রমি ও ছোট মেয়ে ফাইজা রহমান রিমি। বড়টার চেয়ে ছোটটা খুব চটপটে। সাজেক যাওয়ার কথা শুনে সেদিন থেকে দিন গুনতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এলো সাজেক যাওয়ার সময়। মাত্র একদিন বাকী, এর আগে সম্পাদক স্যার আমার পরিবারের সবাইকে অফিসে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকেট দিয়েছেন, দুপুরে লাঞ্চ করিয়েছেন, এমনকি থাকা খাওয়ার খরচও দিয়েছেন। আমার সব কিছুতে তিনি অত্যন্ত আন্তরিক, একজন সম্পূর্ণ অবিভাবকের দ্বায়িত্ব পালন করেন।

১৫ জুন ২০২৩, সকাল ৭.৪৫ মি. বাংলাদেশ বিমানে আমরা চট্রগ্রাম যাবো। ফজরের নামাজ পড়ে আমরা তৈরি হচ্ছিলাম, স্যার ফোন করে বললেন, জাহিদ সাহেব আমি আপনাদের জন্য গাড়ি নিয়ে কমলাপুর অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি আসেন। আমরা তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লাম। এই প্রথম আমি বিমানে কোথাও যাচ্ছি, তিনি আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। সমস্ত চেক ও বেডিং পাস করে আমরা গিয়ে বিমানে উঠলাম, এক নতুন অভিজ্ঞতা, এই প্রথম বিমানে ওঠা। বিমান যখন মেঘের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো, অন্যরকম  একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো যা বুঝাতে পারবো না। ৪০/৪৫ মিনিটের মধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে একটি সিএনজি নিয়ে অক্সিজেন মোড় চলে গেলাম। কোন রকম সকালের নাস্তা করে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। খাগড়াছড়ি হতে সাজেক যাওয়ার গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। অফিসের কলিগ মো. ছাব্বির হোসাইন অত্যন্ত সুন্দর মনের একজন মানুষ।  পূর্বে সাজেক গিয়েছে তাই সমস্ত পথঘাট চেনা। আমি সাজেক যাবো শুনেই ওর পরিচিত ড্রাইভার মো. রফিকুল ইসলামকে বলে অন্য একজন ড্রাইভার ও হোটেল বুকিং করে দিলো। ড্রাইভার রমজান বার বার কল করছিলো আমরা কখন পৌছাবো জানার জন্য। খাগড়াছড়ি পৌছাতে পৌনে দুইটা বেজে গেলো। ড্রাইভার রমজান তাড়াতাড়ি ল্যাগেজ গাড়িতে উঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দুরত্ব ৪৫ কি. মি.। আমরা যখন বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌছাই তখন বেলা ২টা ৪৫ মি.। এখান থেকে আর্মি বিডিয়ারের যৌথ প্রহরায় পর্যটকদের গাড়ি বহর সাজেক নিয়ে যাওয়া হয়। ড্রাইভার রমজান আমাদেরকে গাড়ীতে রেখে চেক পোস্ট-এ গিয়ে জানালো গাড়ী পথে লেট করেছে তাই সময় মতো আসতে পারেনি, যেহেতু আমরা ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে এসেছি তাই টোকেন দিয়ে যেতে বললেন। পাহাড়ি পথ গাড়ী খুব সাবধানে চালাতে হয়। কখনো ১৫০/২০০ ফুট পাহাড়ে উঠে আবার নীচে নামতে হয়। মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছিলো নাজানি কখন গাড়ি উল্টে খাদে পড়ে যায়। পথে যেতে চোখে পড়লো সারি সারি আমগাছ, গাছগুলো যেন আমের ডিসপ্লে। পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে জুম চাষের প্রক্রিয়া চলছিলো। উঁচু উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে, সুন্দর চটুল ছন্দে বয়ে চলছে নদী।৷ এখানকার বড় নদীগুলোর মধ্যে হলো চেঙ্গি, মাইনি ও মাচালং। মাচালং নদীটির উৎপত্তি স্থল ভারতের ত্রিপুরা। পথে যেতে চোখে পড়লো মাচালং, মাঘাইছড়ি, দিঘিনালা, টাইগার টিলা আর্মি ক্যাম্প। রয়েছে ভারতের উদয়পুর বর্ডার। আর্মি, বিডিয়ার ক্যাম্পগুলি যেন সদাজাগ্রত ও নিরাপত্তা বিধানে ব্যস্ত।  সাজেকের আদিবাসিন্দা হলো চাকমা, লুসাই ও ত্রিপুরা ইত্যাদি। এরা মূলতো ভারতের অধিবাসী, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, যে অংশ বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে সে অঞ্চলে এরা থেকে যায়। আজকের পাহাড়ি অঞ্চল এমন নিরাপদ ও ভীতিহীন কখনোই ছিলো না। পাহাড়িরা নিজেদের  আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করে আসছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের এ দাবি মেনে না নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহ ও শান্তিচুক্তির মাধ্যমে স্বস্তির অবস্থা ফিরে এসেছে। এ এলাকায় বাঙালিদের বসবাস শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। একসময় ঘনঅরণ্যে পরিপূর্ণ  ছিলো । তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ এ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের আহবান জানালে বিভিন্ন এলাকা হতে লোক এসে বনজঙ্গল পরিস্কার করে বসতি স্থাপন করে। আস্তে আস্তে বাঙালিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। আলাপচারীতায় জানতে পারলাম ড্রাইভার রমজানের পূর্বপুরুষ এসেছিল ময়মনসিংহ থেকে।  রাস্তার পাশে দেখা যাচ্ছিলো আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘর। এক অপূর্ব মহিমায় যেন মহান রাব্বুল আলামিন সৃষ্টি করেছেন এই পাহাড় নদী, যেন সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মেষ যেন পাহাড়ের গায় চুম্বন একে লেগে রয়েছে। পাহাড়, নদী আর গাছাপালা দেখতে আমরা পৌছে গেলাম সাজেকে।

সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। দিন দিন ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে সাজেকের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে তাই সরকার  সাজেককে থানায় রূপান্তরিত করেছেন। এর ফলে এ এলাকার জনগণ আগের চেয়ে অনেকটা নিরাপদ। উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা অবস্থিত। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি যেন এক প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ। যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ, এ যেন বাংলাদেশের দার্জিলিং।  প্রকৃতি এখানে সকাল বিকাল রঙ বদলায়। কখনো ঝলমলে আলো আবার হঠাৎ মেঘে ছেয়ে যায়। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে। মেঘ এসে যেন হাতের কাছে ধরা দেয়। কেউ না গেলে সাজেকের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা কল্পনাও করতে পারবে না।

থাকার কটেজের বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম ১৫ দিন আগে। আমরা যখন সাজেক পৌছাই তখন বেলা সাড়ে পাঁচটা। সুন্দর ছিমছাম কাঠের ঘর, টিনের ছাউনি, একরুমে দুটি খাট বিছানো রয়েছে। দক্ষিণে বিশাল বারান্দা। শিল্পীর তুলিতে আঁকা যেন নিপুণ ছবি। নাম অধরা রিসোর্ট। যেহেতু আমাদের ভ্রমণের সময় স্বল্প তাই ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাজেক জিরো পয়েন্টে গেলাম, কিছু সময় ঘোরাঘুরি করে নাস্তা করলাম। সবচেয়ে আকর্ষণ হলো বাশেঁর কাপে চা পান। এরপর রুমে গিয়ে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম, কিছু কেনাকাটা  করলাম। এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো রুমে চলে এলাম। এখানে খাবার হোটেলগুলোর আলাদা একটা বৈচিত্র, খাবার খেতে হলে ২/৩ ঘটা আগে অর্ডার করতে হয়। রুম সার্ভিস ছেলেটাকে ডেকে খাবারের অর্ডার করলাম। এখানকার খাবেরের মূল আকর্ষণ হলো ব্যাম্বো চিকেন বিরিয়ানি। বাঁশের মধ্যে চিকেন, মসলাও রাইস দিয়ে আগুনে বাঁশ পুড়িয়ে এ খাবার রান্না করা হয়। এটি অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। ১০টার মধ্যে খাবার এলো রাতের খাবার খেলাম। সারাদিন অনেক পথ জার্নি  করার কারণে খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কখনো মেঘের এতো কাছ থেকে বৃষ্টি উপভোগ করিনি, মনে হচ্ছিলো মেঘ যেনো আমাদের কটেজের উপরেই এসে পড়েছে । বৃষ্টির পাশাপাশি প্রচুর ঠান্ডা অনুভব হচ্ছিলো। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলাম, এসম ঢাকা শহরের তাপমাত্রা ৩৫-৪০ ডিগ্রি থাকে। আর এখানে  শীত লাগায় খুব ভালোই লাগছিলো।  ফজরের নামাজ পড়ে বাইরে তাকাতেই অপূর্ব সৌন্দর্য চোখে পড়লো। মেঘগুলো যেন জানালা দিয়ে উঁকি মারছিলো। তখনো রিমিঝিম বৃষ্টি হচ্ছিলো। মেয়ে দুটোকে ডেকে উঠালাম ওরা বেলকুনিতে গিয়ে নাচলো গান করলো। এর পর আমরা ল্যাগেজ গুছিয়ে  নাস্তা করার জন্য বের হলাম। হোটেলে ঢুকতেই প্রচন্ড বৃষ্টি  হলো। ভেবেছিলাম নাস্তা করে কংলাক পাহাড় দেখতে যাবো, বৃষ্টির কারণে তা পন্ড হয়ে গেলো।

নাস্তা করে আবার গাড়িতে উঠলাম, সাজেক ক্যাম্পে টিকেট কেটে খাগড়াছড়ির পথে রওনা হলাম। খাগড়াছড়ি এসেছি কিন্তু আলু টিলা পাহাড়, আলুটিলা গুহা, ঝুলন্ত ব্রীজ, রিসাং ঝর্ণা দেখবো না তাকি হয়। দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকা আসার জন্য রাত ১০.৩০ মিনিটে হানিফ গাড়ির ৩টি টিকিট কাটলাম। আবার  যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমে গেলাম রিসাং ঝর্ণা দেখতে, এটি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত। ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। গাড়ী রেখে মেয়েদের নিয়ে ঝর্ণা দেখতে চললাম, প্রায় হাফ কিলোমিটার হেটে ঝর্ণার কাছে গেলাম এখান থেকে ১০০ ফুটের বেশি সিড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। মেয়েরা যেতে পারলেও স্ত্রী আসমাকে নীচে নামাতে কষ্ট হলো, এমনিতে সে ডায়াবেটিসের রোগী। তাই অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়, তারপরও যুদ্ধে এসে রনে ভঙ্গ দিলেতো চলে না। কোনমতে সবাইকে নিয়ে ঝর্ণা দেখলাম, আকাশে প্রচুর মেঘ, তাড়াহুড়ো করে উপরে চলে এলাম। কোনমতে হাটতে পারছিলো না, তাই স্ত্রী আসমাকে একটি মোটরসাইকেলে উঠিয়ে দিলাম, কষ্ট হবে ভেবে ছোট মেয়ে রিমিকে পাঠিয়ে দিলাম। বড় মেয়ে প্রমিকে নিয়ে আমি হেটে হেটে গাড়ির কাছে এলাম আবার যাত্রা শুরু, এবার গন্তব্য ঝুলন্ত ব্রীজ ও আলুটিলা গুহা। গাড়ি থেকে নেমে মেয়েদের নিয়ে নীচে নামতে থাকলাম প্রায় ১০/১২ মিনিট নীচে নামার পর গুহার সন্ধান পেলাম। গুহাটির দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট, অন্ধকার ও কর্দমাক্ত তাই মেয়েদের বায়না সত্বেও ভিতরে প্রবেশ করলাম না। ভিতরে অক্সিজেন সমস্যা হতে পারে ভেবে গুহার সামনে তিন জনের পিক  তুললাম। এরপর ঝুলন্ত ব্রীজে  উঠলাম ছবি তুললাম। এরমধ্যে বেলা শেষ সন্ধে হয়ে এলো, হালকা নাস্তা করে, আবার যাত্রা করলাম এবার কোন দর্শনীয় স্থান নয়, সোজা খাগড়াছড়ি শহরে হানিফ কাউন্টারে। ল্যাগেজ নামিয়ে কাউন্টারে রেখে রমজান ভাইকে ভাড়া দিলাম। খুব সুন্দর ও ভালো মনের মানুষ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, ভালো লাগছিলো না, ভাবলাম সাংবাদিক মনির উদ্দিন মুন্নাকে কল করি। সজিবের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কল করলাম। মুন্না ভাই স্ত্রী-বাচ্চাসহ এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন। সবাই মিলে নাস্তা করলাম। মুন্না ভাই রাত ৯.৩০ মিনিট পর্যন্ত থেকে চলে গেলেন। রাত ১১টায় খাগড়াছড়ি হতে গাড়ি ছাড়লো সারাদিন পাহাড়ে হেটে সবাই ক্লান্ত। অনেক স্মৃতি ও আনন্দ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলাম। তখনও মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো সাজেক, সাদা মেঘের অপরূপ সৌন্দর্য, লুসাই পল্লী, কংলাক পাহাড়, উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তা, আলুটিলা, রিসাং ঝর্ণা, অন্ধকার গুহা, পাহাড় থেকে সমস্ত খাগড়াছড়িকে দেখা, মনে হচ্ছিলো  আমরা আরেক নতুন স্থানে ঘুরতে যাচ্ছি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কল্পনাও করতে পারছি না।