০৯:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞপ্তি

ঐতিহ্যের ঐশ্বর্যে এগিয়ে যাক পর্যটন শিল্প

প্রতিনিধির নাম

 

শৈশবে পড়েছি-
বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর
জ্বালিল জ্ঞানের দ্বীপ তীব্বতে বাঙালি দীপংকর।

বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মাঝে গৌতম বুদ্ধের পর পূজিত হন তিনি। তাঁর জন্মস্থান মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামে। তাঁর বাসস্থান এখনও ‘পন্ডিত ভিটা’ নামে পরিচিত। প্রাচীন বাঙলায় পাল আমলে মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুর অঞ্চলটি সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের তীর্থকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থান করেছিলেন এবং সেখানে বৌদ্ধ স্তুপ রয়েছে। ফলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বাংলাদেশ অন্যতম একটি পবিত্র স্থান।
বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রবলভাবে বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে। এ সময় বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ছাড়া বাকি অঞ্চল পাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১১ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রকাশনা না থাকায় বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে সহজে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে বুড্ডিস্ট হেরিটেজ অব বাংলাদেশ নামে ইংরেজি ভাষায় একটি দৃষ্টিনন্দন বৃহদাকার বই প্রকাশিত হয়েছে। এখানে ভূমিকাসহ ১৭টি মূল্যবান প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। বইটি সম্পাদনা করেছেন বুলবুল আহমেদ।
পযর্টনের অপার সম্ভাবনা হতে পারে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়সহ প্রাচীন বুদ্ধিস্ট স্থাপনাগুলো। পার্বত্যাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় থাকা শত শত বছরের পুরনো স্থাপত্যশৈলী ও নিদর্শনগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। এ জন্য সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের বৌদ্ধ স্থাপনা সমূহের ইতিবৃত্ত, ছবি, যাতায়ত ব্যবস্থা, আবাসিক সুবিধাসহ সামগ্রিক তথ্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ওয়েব সাইটে থাকতে হবে। অনলাইনে বুকিং, হটলাইন নাম্বারসহ তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করার অপশন ওয়েবসাইটে থাকতে হবে।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক পেতে পারে। এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আরও ত্বরান্বিত হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ট্যুরিজম পরিচালনাকারীদের মধ্যে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
মসলিন মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য। ইরাকের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র মসুলে পাওয়া যেত অতিসূ² কাপড়। মসুলের সূ² কাপড়তুল্য ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র নাম-বিবর্তনের ধারায় হয় মসলিন। রাজকীয় পোশাক ঢাকাই মসলিন।, ঠুট কার্পাস চড়কায় কেটে সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সূতায় হাত বোনা স্বচ্ছ ও অতিসূ² কাপড়।
মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের আছে দীর্ঘ ইতিহাস। রোম সাম্রাজ্যের সোনালি অতীতেও রোমান নারীদের প্রিয় পোশাকের নাম ঢাকাই মসলিন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সোনারগাঁয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করছেন। সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলও সোনারগাঁয়ের সূ² বস্ত্রের ভূয়সী করেছেন। পারস্যের কবি হাফিজ সোনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গজর রচনা করেন, সুলতানও কবিকে ‘মসলিন’ উপহার পাঠিয়ে সম্মানিত করেন।
মুসলিম বাংলার গর্ব মসলিন ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের ধারায় হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া ঐহিহ্যের বর্ণনায় ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম রচনা করেছেন ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থ। জানা যায়, উনিশ শতকে তৈরি একটি মসলিন ১৮৫১ সালে বিলেতে প্রদর্শিত হয়েছিল। এক হাজার এক গজ এই মসলিনের ওজন ছিল আট তোলা। ঢাকা জাতীয় জাদুঘর সংরক্ষিত এক হাজার দুই গজ মসলিনের ওজন সাত সাত তোলা। কথিত আছে, ৫০ মিটার দীর্ঘ একটি মসলিন অনায়াসে একটি দিয়াশলাই বাক্সে রাখা যেত। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে।
আশার কথা, গবেষক ও তাঁতিদের নিবিড় প্রয়াস ও সরকারের আন্তরিক সহযোগিতায় মসলিনের পূনর্জন্ম হয়েছে। আমাদের এ ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই দলে দলে পর্যটকরা এ দেশে আসতে লাইন ধরবে। এ জন্য একটি ‘মসলিন পল্লী’ বানানো সময়ের দাবী।
আমরা জানি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ যেটি মহামহোপাধ্যায় হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে ১৯০৭ সালে উদ্ধার করেন। তাঁর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে ‘‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলো রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাতও হয়েছিলো এই চর্যাপদ থেকেই। সে বিবেচনায় এটি একটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলোতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ এখনও চিত্তাকর্ষক। কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।
চর্যার একটি পদ :
‘নগর বাহিরে ডোম্বি তোহারি কুড়িয়া
ছোই ছোই যাসি ব্রাহ্মণ নাড়িয়া’
-আধুনিক বাংলা অর্থ হল: যারা ডোম মানে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষ, তারা সাধারণত মূল নগরীতে স্থান পায় না, তারা শহরের উপকন্ঠে বাস করে। কিন্তু তাদের সেই কুঁড়েঘরে ডোমদের মেয়েদের কাছে ব্রাহ্মণ; মানে সমাজের সবচেয়ে উঁচুতলার বাসিন্দা চুপে চুপে যায়। এটি বর্তমান সমাজেও এটি জারি আছে।
তাই চর্যাপদের পদগুলোকে এখনও প্রাসঙ্গিক বলতে পারি।
আমরা যদি বুদ্ধিস্ট সার্কিট দেশসমূহকে জানাতে পারি- ৩৫ কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষার উৎস তাদের ধর্মীয় বাণী সম্বলিত অনুশাসনমাত্র। এবং চর্যাপদকে চায়নাসহ আশপাশের দেশসমূহের ভাষায় অনুবাদ করে। দেশে একটি ভাষা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে পারি। তবে এটিও পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম উপায় হতে পারে।
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষকে ঘিরে রাজধানী ঢাকায় যে পরিমাণ জমায়েত হয় তা বিশ্বে সর্ববৃহৎ। বর্ষবরণে ঢাকা ও দেশের নগরসমূহ ছাড়াও ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে এক উৎসব রচিত হয়, মেলা, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ এ অনুষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশকে এক নতুন পরিচিতি দিয়েছে। আমরা যদি বর্ষবরণের এ প্রাণের উৎসবকে যথাযথভাবে ছড়িয়ে দিতে পারি এটি আমাদের পর্যটন বিকাশে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
ভাষার জন্য রক্ত দেবার ইতিহাস বিশ্বে বিরল। আমরা সেই সে জাতি মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের পূর্বসূরী সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। সেই শহীদদের স্মরণে আমরা গেয়ে উঠি-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি’–
সীমানা পেরিয়ে একুশ এখন পৃথিবীর পাথেয়। একুশের আত্মত্যাগের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মাতৃভাষাকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা-ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। সেই থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি’।
অমর একুশের স্মরণে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমি জুড়ে বসে গ্রন্থমেলা; যা ইতোমধ্যে বাঙালির প্রাণের মেলায় রূপ নিয়েছে। একুশের ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে শহীদ মিনারে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে যে জনস্রোত বয়ে যায় এবং পরদিন বইমেলায় যে জনসমাগম হয় সেটি সত্যি অবাক করার বিষয়। আমরা যদি পৃথিবীর প্রতিটি প্রাঙ্গণে আমাদের আয়োজনের ব্যাপকতাকে ছড়িয়ে দিতে পারি তবে নিশ্চয়ই নানা প্রান্তের বাসিন্দারা এটি উপভোগ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে; যা আমাদের পর্যটনকে দারুণভাবে বিকশিত করবে।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অনন্য এবং অসাধারণ এই কারণে যে, এই ভাষণ সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একতাবদ্ধ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর সেই জাদুকরী ভাষণ দেশের জনগণের মাঝে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী সব জনগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ তাদের মনোজাগতিক উদ্দীপনার অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। আর এ কারণেই এ ভাষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনেস্কো কর্তৃক মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার কমিটি চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে সবাই একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে স্বীকৃতির জন্য নির্বাচিত করে।
আমরা যদি ৭ মার্চের ভাষণকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিতে পারি এবং ৭ মার্চের ভাষণের স্থান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানকে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সুন্দরভাবে সাজাতে পারি তাহলে একদিকে জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব ও মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি করবে তেমনি পর্যটকদেরও এ সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে যা আমাদের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
আমাদের ঈদ উৎসব, মহররম, দুর্গাপূজা, আমাদের নানা ধরণের সংগীত-জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওইয়া, গম্ভীরা আমাদের জাতিসত্তাকে বিশেষ ঐতিহ্যমন্ডিত করেছে। এর ঐতিহ্যর কথা বিশ্ববাসীকে জানান দিতে হবে। তাদেরকে আহŸান করতে হবে যথাযথভাবে, তবেই তারা এ অনন্য জাতির বৈচিত্রময়তা দেখতে ভিড় জমাবে।
বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন নগরী। ঢাকার পুরোনো ইতিহাস গৌরবময়। এক হিসেবে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল ঢাকা এবং সেরা শহরের ক্রমসংখ্যায় ঢাকার স্থান ছিল দ্বাদশতম। এ শহরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হেয়েছ বাংলার এবং পরবর্তীকালের পূর্ববঙ্গের বা আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস। শুধু তাই নয়, ঢাকাই বোধহয় একমাত্র শহর যেটি চারবার অর্জন করেছে রাজধানীর মর্যাদা। ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্য, নাগরিক জীবন, উৎসব, খাবারসহ ঢাকার গৌরব ছড়িয়ে দিতে হবে। ঢাকায় আসতে আহŸান করেই বসে থাকলে চলবে না, পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যে ঢাকা দেখার জন্য পরিবহন, গাইডসহ আনুষঙ্গিক আয়োজন সুচারুভাবে করতে পারার মধ্য পর্যটনের আর একটি বিপুল সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে।
ইউনেস্কো ঘোষিত বাংলাদেশের বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন ও বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ সুলতানী আমলে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনাসমৃদ্ধ পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচার করতে হবে বিভিন্ন দেশে, জাদুঘর, লাইব্রেরি, তথ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এতে করে ভ্রমণপিপাসুরা এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলদ্ধি করতে পারবে এবং এখানে আসাতে উৎসাহী হবে।
বলা হয় ‘প্রচারেই প্রসার’। আমাদের পর্যটন শিল্পের প্রসারে প্রচার অপরিহার্য। এ পৃথিবী যাতে বাংলাদেশকে চিনতে পারে সে জন্য বাংলাদেশর ইতিহাস, এতিহ্য তুলে ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। দুতাবাসগুলোতে পর্যটন উইং স্থাপন করে পর্যটক টানতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশে একটি অন্তর্জাতিক পর্যটন মেলার আয়োজন করতে হবে এবং এ মেলায় যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশ অংশগ্রহণ করে সেটি নিশ্চিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রনালয় ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।
দেশের এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রাপথে যাতে বাংলাদেশের পর্যটনসৌন্দর্য সম্বলিত চিত্র প্রদর্শন করে সে উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি একটি দেশের বিমানবন্দর হল গেইটওয়ে। এটি একটি ঘরের ড্রয়িংরুমের মত; যেটিকে আমরা সাজিয়ে-গুজিয়ে পরিপাটি করে রাখি; ঠিক তেমনি বিমানবন্দরকেও চমৎকার করে নান্দনিকভাবে সাজাতে হবে, যাত্রীসেবা হতে হবে আন্তরিক ও হয়রানিমুক্ত; যাতে করে একজন পর্যটক বা আগন্তুকের শুরুতই দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। বিমানবন্দর থেকে শহরে আসা ঝামেলামুক্ত করতে পর্যাপ্ত পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিমানবন্দরে পর্যটককে সহায়তার জন্য পর্যটন ডে‹ে ঢেলে সাজাতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ; বাংলাদেশ। এর ঐতিহ্যের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে এর উৎসব, স্থাপত্য, ইতিহাস, সংগীত এবং ধর্মর মধ্যে। পর্যটনের কাংখিত বিকাশে ঐতিহ্য অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে; কারণ এটি একদিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ তৈরি করে অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধন করতে পারে। সময়ের পরিবর্তিত চাহিদানুযায়ী নান্দনিক বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ হেরিটেজ ট্যুরিজম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর এ ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
-মাহবুবুর রহমান তুহিন, জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সৎঃঁযরহ৭৮@মসধরষ.পড়স

ট্যাগস :
আপডেট : ০৯:৪৩:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অক্টোবর ২০২২
২৭৬ বার পড়া হয়েছে

ঐতিহ্যের ঐশ্বর্যে এগিয়ে যাক পর্যটন শিল্প

আপডেট : ০৯:৪৩:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অক্টোবর ২০২২

 

শৈশবে পড়েছি-
বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর
জ্বালিল জ্ঞানের দ্বীপ তীব্বতে বাঙালি দীপংকর।

বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মাঝে গৌতম বুদ্ধের পর পূজিত হন তিনি। তাঁর জন্মস্থান মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামে। তাঁর বাসস্থান এখনও ‘পন্ডিত ভিটা’ নামে পরিচিত। প্রাচীন বাঙলায় পাল আমলে মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুর অঞ্চলটি সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের তীর্থকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থান করেছিলেন এবং সেখানে বৌদ্ধ স্তুপ রয়েছে। ফলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বাংলাদেশ অন্যতম একটি পবিত্র স্থান।
বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রবলভাবে বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে। এ সময় বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ছাড়া বাকি অঞ্চল পাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১১ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রকাশনা না থাকায় বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে সহজে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে বুড্ডিস্ট হেরিটেজ অব বাংলাদেশ নামে ইংরেজি ভাষায় একটি দৃষ্টিনন্দন বৃহদাকার বই প্রকাশিত হয়েছে। এখানে ভূমিকাসহ ১৭টি মূল্যবান প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। বইটি সম্পাদনা করেছেন বুলবুল আহমেদ।
পযর্টনের অপার সম্ভাবনা হতে পারে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়সহ প্রাচীন বুদ্ধিস্ট স্থাপনাগুলো। পার্বত্যাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় থাকা শত শত বছরের পুরনো স্থাপত্যশৈলী ও নিদর্শনগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। এ জন্য সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের বৌদ্ধ স্থাপনা সমূহের ইতিবৃত্ত, ছবি, যাতায়ত ব্যবস্থা, আবাসিক সুবিধাসহ সামগ্রিক তথ্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ওয়েব সাইটে থাকতে হবে। অনলাইনে বুকিং, হটলাইন নাম্বারসহ তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করার অপশন ওয়েবসাইটে থাকতে হবে।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক পেতে পারে। এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আরও ত্বরান্বিত হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ট্যুরিজম পরিচালনাকারীদের মধ্যে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
মসলিন মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য। ইরাকের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র মসুলে পাওয়া যেত অতিসূ² কাপড়। মসুলের সূ² কাপড়তুল্য ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র নাম-বিবর্তনের ধারায় হয় মসলিন। রাজকীয় পোশাক ঢাকাই মসলিন।, ঠুট কার্পাস চড়কায় কেটে সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সূতায় হাত বোনা স্বচ্ছ ও অতিসূ² কাপড়।
মুসলিম বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের আছে দীর্ঘ ইতিহাস। রোম সাম্রাজ্যের সোনালি অতীতেও রোমান নারীদের প্রিয় পোশাকের নাম ঢাকাই মসলিন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সোনারগাঁয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করছেন। সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলও সোনারগাঁয়ের সূ² বস্ত্রের ভূয়সী করেছেন। পারস্যের কবি হাফিজ সোনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গজর রচনা করেন, সুলতানও কবিকে ‘মসলিন’ উপহার পাঠিয়ে সম্মানিত করেন।
মুসলিম বাংলার গর্ব মসলিন ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের ধারায় হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া ঐহিহ্যের বর্ণনায় ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম রচনা করেছেন ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থ। জানা যায়, উনিশ শতকে তৈরি একটি মসলিন ১৮৫১ সালে বিলেতে প্রদর্শিত হয়েছিল। এক হাজার এক গজ এই মসলিনের ওজন ছিল আট তোলা। ঢাকা জাতীয় জাদুঘর সংরক্ষিত এক হাজার দুই গজ মসলিনের ওজন সাত সাত তোলা। কথিত আছে, ৫০ মিটার দীর্ঘ একটি মসলিন অনায়াসে একটি দিয়াশলাই বাক্সে রাখা যেত। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে।
আশার কথা, গবেষক ও তাঁতিদের নিবিড় প্রয়াস ও সরকারের আন্তরিক সহযোগিতায় মসলিনের পূনর্জন্ম হয়েছে। আমাদের এ ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই দলে দলে পর্যটকরা এ দেশে আসতে লাইন ধরবে। এ জন্য একটি ‘মসলিন পল্লী’ বানানো সময়ের দাবী।
আমরা জানি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ যেটি মহামহোপাধ্যায় হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে ১৯০৭ সালে উদ্ধার করেন। তাঁর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে ‘‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলো রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাতও হয়েছিলো এই চর্যাপদ থেকেই। সে বিবেচনায় এটি একটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলোতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ এখনও চিত্তাকর্ষক। কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।
চর্যার একটি পদ :
‘নগর বাহিরে ডোম্বি তোহারি কুড়িয়া
ছোই ছোই যাসি ব্রাহ্মণ নাড়িয়া’
-আধুনিক বাংলা অর্থ হল: যারা ডোম মানে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষ, তারা সাধারণত মূল নগরীতে স্থান পায় না, তারা শহরের উপকন্ঠে বাস করে। কিন্তু তাদের সেই কুঁড়েঘরে ডোমদের মেয়েদের কাছে ব্রাহ্মণ; মানে সমাজের সবচেয়ে উঁচুতলার বাসিন্দা চুপে চুপে যায়। এটি বর্তমান সমাজেও এটি জারি আছে।
তাই চর্যাপদের পদগুলোকে এখনও প্রাসঙ্গিক বলতে পারি।
আমরা যদি বুদ্ধিস্ট সার্কিট দেশসমূহকে জানাতে পারি- ৩৫ কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষার উৎস তাদের ধর্মীয় বাণী সম্বলিত অনুশাসনমাত্র। এবং চর্যাপদকে চায়নাসহ আশপাশের দেশসমূহের ভাষায় অনুবাদ করে। দেশে একটি ভাষা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে পারি। তবে এটিও পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম উপায় হতে পারে।
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষকে ঘিরে রাজধানী ঢাকায় যে পরিমাণ জমায়েত হয় তা বিশ্বে সর্ববৃহৎ। বর্ষবরণে ঢাকা ও দেশের নগরসমূহ ছাড়াও ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে এক উৎসব রচিত হয়, মেলা, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ এ অনুষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশকে এক নতুন পরিচিতি দিয়েছে। আমরা যদি বর্ষবরণের এ প্রাণের উৎসবকে যথাযথভাবে ছড়িয়ে দিতে পারি এটি আমাদের পর্যটন বিকাশে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
ভাষার জন্য রক্ত দেবার ইতিহাস বিশ্বে বিরল। আমরা সেই সে জাতি মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের পূর্বসূরী সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। সেই শহীদদের স্মরণে আমরা গেয়ে উঠি-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি’–
সীমানা পেরিয়ে একুশ এখন পৃথিবীর পাথেয়। একুশের আত্মত্যাগের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মাতৃভাষাকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা-ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। সেই থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি’।
অমর একুশের স্মরণে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমি জুড়ে বসে গ্রন্থমেলা; যা ইতোমধ্যে বাঙালির প্রাণের মেলায় রূপ নিয়েছে। একুশের ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে শহীদ মিনারে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে যে জনস্রোত বয়ে যায় এবং পরদিন বইমেলায় যে জনসমাগম হয় সেটি সত্যি অবাক করার বিষয়। আমরা যদি পৃথিবীর প্রতিটি প্রাঙ্গণে আমাদের আয়োজনের ব্যাপকতাকে ছড়িয়ে দিতে পারি তবে নিশ্চয়ই নানা প্রান্তের বাসিন্দারা এটি উপভোগ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে; যা আমাদের পর্যটনকে দারুণভাবে বিকশিত করবে।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অনন্য এবং অসাধারণ এই কারণে যে, এই ভাষণ সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একতাবদ্ধ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর সেই জাদুকরী ভাষণ দেশের জনগণের মাঝে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী সব জনগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ তাদের মনোজাগতিক উদ্দীপনার অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। আর এ কারণেই এ ভাষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনেস্কো কর্তৃক মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার কমিটি চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে সবাই একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে স্বীকৃতির জন্য নির্বাচিত করে।
আমরা যদি ৭ মার্চের ভাষণকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিতে পারি এবং ৭ মার্চের ভাষণের স্থান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানকে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সুন্দরভাবে সাজাতে পারি তাহলে একদিকে জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব ও মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি করবে তেমনি পর্যটকদেরও এ সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে যা আমাদের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
আমাদের ঈদ উৎসব, মহররম, দুর্গাপূজা, আমাদের নানা ধরণের সংগীত-জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওইয়া, গম্ভীরা আমাদের জাতিসত্তাকে বিশেষ ঐতিহ্যমন্ডিত করেছে। এর ঐতিহ্যর কথা বিশ্ববাসীকে জানান দিতে হবে। তাদেরকে আহŸান করতে হবে যথাযথভাবে, তবেই তারা এ অনন্য জাতির বৈচিত্রময়তা দেখতে ভিড় জমাবে।
বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন নগরী। ঢাকার পুরোনো ইতিহাস গৌরবময়। এক হিসেবে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল ঢাকা এবং সেরা শহরের ক্রমসংখ্যায় ঢাকার স্থান ছিল দ্বাদশতম। এ শহরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হেয়েছ বাংলার এবং পরবর্তীকালের পূর্ববঙ্গের বা আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস। শুধু তাই নয়, ঢাকাই বোধহয় একমাত্র শহর যেটি চারবার অর্জন করেছে রাজধানীর মর্যাদা। ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্য, নাগরিক জীবন, উৎসব, খাবারসহ ঢাকার গৌরব ছড়িয়ে দিতে হবে। ঢাকায় আসতে আহŸান করেই বসে থাকলে চলবে না, পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যে ঢাকা দেখার জন্য পরিবহন, গাইডসহ আনুষঙ্গিক আয়োজন সুচারুভাবে করতে পারার মধ্য পর্যটনের আর একটি বিপুল সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে।
ইউনেস্কো ঘোষিত বাংলাদেশের বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন ও বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ সুলতানী আমলে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনাসমৃদ্ধ পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচার করতে হবে বিভিন্ন দেশে, জাদুঘর, লাইব্রেরি, তথ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এতে করে ভ্রমণপিপাসুরা এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলদ্ধি করতে পারবে এবং এখানে আসাতে উৎসাহী হবে।
বলা হয় ‘প্রচারেই প্রসার’। আমাদের পর্যটন শিল্পের প্রসারে প্রচার অপরিহার্য। এ পৃথিবী যাতে বাংলাদেশকে চিনতে পারে সে জন্য বাংলাদেশর ইতিহাস, এতিহ্য তুলে ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। দুতাবাসগুলোতে পর্যটন উইং স্থাপন করে পর্যটক টানতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশে একটি অন্তর্জাতিক পর্যটন মেলার আয়োজন করতে হবে এবং এ মেলায় যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশ অংশগ্রহণ করে সেটি নিশ্চিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রনালয় ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।
দেশের এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রাপথে যাতে বাংলাদেশের পর্যটনসৌন্দর্য সম্বলিত চিত্র প্রদর্শন করে সে উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি একটি দেশের বিমানবন্দর হল গেইটওয়ে। এটি একটি ঘরের ড্রয়িংরুমের মত; যেটিকে আমরা সাজিয়ে-গুজিয়ে পরিপাটি করে রাখি; ঠিক তেমনি বিমানবন্দরকেও চমৎকার করে নান্দনিকভাবে সাজাতে হবে, যাত্রীসেবা হতে হবে আন্তরিক ও হয়রানিমুক্ত; যাতে করে একজন পর্যটক বা আগন্তুকের শুরুতই দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। বিমানবন্দর থেকে শহরে আসা ঝামেলামুক্ত করতে পর্যাপ্ত পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিমানবন্দরে পর্যটককে সহায়তার জন্য পর্যটন ডে‹ে ঢেলে সাজাতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ; বাংলাদেশ। এর ঐতিহ্যের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে এর উৎসব, স্থাপত্য, ইতিহাস, সংগীত এবং ধর্মর মধ্যে। পর্যটনের কাংখিত বিকাশে ঐতিহ্য অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে; কারণ এটি একদিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ তৈরি করে অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধন করতে পারে। সময়ের পরিবর্তিত চাহিদানুযায়ী নান্দনিক বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ হেরিটেজ ট্যুরিজম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর এ ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
-মাহবুবুর রহমান তুহিন, জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সৎঃঁযরহ৭৮@মসধরষ.পড়স